ধর্মের বাঁধন এবং আইনের শাসন আমাদেরকে কি সভ্য করতে পেরেছে? আজকের সুসভ্যের দাবিদার আমাদের সমাজ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে এ বিষয়টি আমাদের বিবেককে বার বার নাড়া দিচ্ছে। লালমনির হাটের বুড়িমারিতে ক্ষিপ্ত জনগণ এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মারার মত জঘন্যতম ও বর্বর একটি ঘটনা সম্প্রতি ঘটে গেল।
একুশ শতকের এ সময়ে বাংলাদেশে অসভ্যযুগের এমন একটি ঘটনা অবিশ্বাস্য। নিহত যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ মাগরিব নামাজের পর তিনি মোটর সাইকেলে এসে মসজিদে ঢুকেছিলেন। সে সময়ে পবিত্র কোরান অবমাননাকর কাজ করেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে শত শত মানুষ চলে আসে এবং তাকে পেটাতে শুরু করে। এ অবস্থায় সেখানে উপস্থিত কিছু সজ্জন ব্যক্তি তাকে বাঁচাতে বুড়িমারি ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যায়। সেখানেও উত্তেজিত জনতা ধাওয়া করে। অফিস ভেঙ্গে তাকে বাইরে নিয়ে আসে এবং বেদম প্রহার করতে থাকে। যুবকের মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে হতভাগ্য যুবকের গায়ে আগুন ধরিয়ে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়। ঘটনাটি হৃদয় বিদারক। পবিত্র কোরানের অবমাননা নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু তার শাস্তি কি পুড়িয়ে মারা? প্রকৃত সত্য হলো, নিহত যুবকের মানসিক ভারসাম্য ছিল না, এছাড়া সে যে কোরান অবমাননা করেছেন তার কোন প্রমাণও ছিল না। যুবক মসজিদে ঢুকেছিলেন কোরানের অবমাননা করতে না কি নামাজ পড়তে? এসব সত্যাসত্য প্রমাণ হওয়ার আগেই শত শত লোক শুধু গুজব শুনেই উত্তেজিত হয়ে ছুটে এসে এক ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারল, এটা মেনে নেয়া যায় কি?
স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে যা বলেছে তা ঘটনা নিয়ন্ত্রণে, তাদের অনিচ্ছা বা অক্ষমতার সাফাই ছাড়া আর কিছু নয়। মাগরিবের নামাজের সময় কে বা কারা গুজব রটনা করে আর শত শত লোক ছুটে এসে তাকে মেরে ফেলল, ঘটনাটা মোটেই তা হতে পারেনা। এ ঘটনার পিছনের ঘটনা খুঁজে বের করা দরকার।
দেশে আরেকটি আলোচিত বিষয় মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তা হলো, নিয়মিত হারে দেশে চলছে ধর্ষণ এবং শিশু ধর্ষণ, বলাৎকার। এসব কর্মকাণ্ডে কিছু রাজনৈতিক পরিবারের পাশাপাশি ধর্মীয় পরিচয়ও প্রকাশ পেয়েছে। সংবাদে প্রকাশিত এ সকল ঘটনায় দেশ জুড়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠে। আন্দোলনকারীরা ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানান। তারই ধারাবাহিকতায় এসব অনৈতিক কার্যাদি দমনের জন্য জনদাবির প্রেক্ষিতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে মহান জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধনী) বিল ২০২০’ পাশ করা হচ্ছে।
আমরা সরকারের এসব নৈতিক আইনানুগ কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানাই। এর সাথে সাথে এও বলতে চাই, শুধু আইন করেই কি এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব? আইনের বিপরীতেও কথা থাকে। এসব আইনের অপপ্রয়োগ হওয়াও অসম্ভব কিছুই নয়। কেউ যদি ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে বা শত্রুতার বশবর্তী হয়ে কাউকে ফাঁসাতে চেষ্টা করে, সেখানে এ আইনটি প্রয়োগ করা খুবই সহজ হবে। এতে সাধারণ সহজ, সরল মানুষ এর শিকারে পরিণত হবে এবং আইনের অপপ্রয়োগে জনদুর্ভোগ বাড়বে। সুতরাং আইন প্রণয়ন করা বা পাশ করানো মুখ্য বিষয় হতে পারেনা। এ আইনের যাতে অপপ্রয়োগ না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বেশি।
অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, আইন দিয়ে অনেক কিছু বন্ধ করা যায় না বরঞ্চ এর অপপ্রয়োগ হয়েছে বেশি। আইন পাসের সাথে সাথে আইনের বিষয়টি সমাজের প্রতিটি স্তরে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় সহ ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং এর কুফল বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে। এসব অনৈতিক কার্যাদির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
আধুনিক সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় যাতে ধর্মের অপপ্রয়োগ না হয় এবং সামাজিক কদাচার এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষতিকর দিকগুলো জনগণের মাঝে বেশি বেশি প্রচার করে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
অগ্রাধিকার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে কয়েক বছরে সরকার অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করলে সড়ক নিরাপদ করা যায়নি। অবহেলার কঠোর শাস্তির বিধান করে নতুন আইন প্রণয়ণ করা হয়েছে। চালকের যথাযথ ট্রেনিং এবং গাড়ির ফিটনেস নিশ্চিত করার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে নানামূখী সিদ্ধান্ত। ত্রুটি দূর করার জন্য পুরাতন সড়কগুলোর সংস্কার করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরী করা হচ্ছে নতুন নতুন সড়ক। তারপরও সড়ক নিরাপদ করার ক্ষেত্রে খুব একটি উন্নতি হয়নি। ‘মুজিববর্ষের শপথ, সড়ক করব নিরাপদ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে পালিত হয়েছে নিরাপদ সড়ক দিবস।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার। স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান এ বিষয়ে সমাজের নিম্নস্তর পর্যন্ত যে সমস্যা তা চিহ্নিত করে বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু সুফল কোনভাবে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে নিয়মিত যাতায়াত করি। প্রায়শ আমার দৃষ্টিতে অনেক ত্রুটি ধরা পড়েছে। সড়কে নিয়মিত উল্টোপথে গাড়ি মহা এক চিন্তার নাম। উল্টোপথে মোটর সাইকেল, রিঙা, টেঙী, ভ্যান গাড়ির চালানোর প্রবণতাকে কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। আইন করে এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
মহাসড়কে উল্টোপথে যান চলাচল এবং রিঙা, ভ্যান ও থ্রিহুইলার চলাচল বন্ধ করতে পারলে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা অর্ধেক বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমি মনে করি। এছাড়াও মহানগর সমূহে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, রাস্তার মুখে শহর এলাকার বাসের অবস্থান, ট্র্যাফিক ব্যবস্থার আরেক চরম ব্যর্থতা। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা ছাড়াও রয়েছে সামাজিক অনিয়ম, দুরাচার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নৈতিকতার বিপর্যয়, ক্ষমতার দাপটে আইন অমান্য এবং আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে নিজ হাতে আইন প্রয়োগের প্রবণতা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্র। আমাদের দেশের মানুষ অনেক কষ্ট সহিষ্ণু। স্বাধীনতার পূর্বেও তাঁরা স্বাধীনতার জন্য, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম চালিয়েছে, এ জন্য কম ত্যাগ করা হয়নি, রক্ত দিতে হয়েছে অনেক। এরপর স্বাধিকার আন্দোলন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামল একটি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা হত্যা করেছি আমাদের জাতির পিতাকে, হত্যা করেছি নিজের বিবেক, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনাকে। বার বার আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। সর্বশেষে অনেক যুদ্ধ, ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল হিসেবে আমরা একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকারকে পেয়েছি। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। চারিদিকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, রাজনৈতিক হত্যা, প্রতিপক্ষ কর্তৃক হামলা, খুন, ভাংচুর, আইন অমান্যের প্রবণতা সামান্য পরিমাণও কমেনি। নৈতিকতার বিপর্যয় সকল দিকে।
আসুন আমরা নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি। নিজে ভালো থাকি এবং অন্যকে ভালো রাখার চেষ্টা করি। এভাবে যদি আমরা এগিয়ে যেতে পারি তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বপ্নের ডিজিটাল আধুনিক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক-শিল্পশৈলী