কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৯ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:০০ পূর্বাহ্ণ

গত দুই বছরেই কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় অন্তত ১২টি হাতির মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য আছে। অনেকের ধারণা এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কক্সবাজারের রামু উপজেলার পানের ছড়া রেঞ্জের আওতাধীন দক্ষিণ মিঠাছড়ি পাহাড়ি এলাকায় আবার একটি বন্য হাতির রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। গত রোববারে মৃত্যুর খবর পেয়ে বনবিভাগের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
কী কারণে হাতিটির মৃত্যু হয়েছে তৎক্ষণাৎ তা বলা না গেলেও অনেকে সন্দেহ করছেন বৈদ্যুতিক শর্টের কারণে হাতিটির মৃত্যু হয়েছে। বনবিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মৃত হাতিটির কাছাকাছি কোথাও বৈদ্যুতিক লাইনের অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বনের মধ্যে দিয়ে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছে, তা থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এর পাশাপাশি অনেকে অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে কেউ এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে কারণ, প্রায় সময় হাতির দল সমতলে নেমে এসে কৃষকদের ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলে। এর আগে চলতি বছরের জুন মাসে টেকনাফের হ্নীলায় বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে লেগে একটি হাতির মৃত্যু হয়েছিল। ওই ঘটনায় অবশ্য বনবিভাগ মামলা দায়ের করে।
কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বিশাল পাহাড়ি এলাকা জুড়ে হাতিদের নিবাস। এই হাতিরা খাদ্যের খোঁজে সমগ্র বনাঞ্চল ঘুরে বেড়াত। এরকম অন্তত ২৬টি করিডোর ছিল যা দিয়ে রাতের বেলা হাতিরা চলাচল করত। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে হাতি চলাচল করত বলে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে রাখা আছে। হাতি চলাচলের সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
তবে অনেক কিছু ক্ষতির সঙ্গে হাতিদের অভয়ারণ্য বা নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ক্যাম্প স্থাপনের কারণে। রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে কমপক্ষে ১০ হাজার একর গভীর বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে বনের মধ্যে হাতিদের খাদ্যের উৎস কমে গেছে। তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। এমনকি হাতিদের বসবাসের স্থান সংকুচিত হয়েছে। দিশাহীন, আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন হাতিরা তাই খাদ্যের খোঁজে নেমে আসে লোকালয়ে। এবং উপায়ান্তরহীনভাবে নষ্ট করে কৃষকের ক্ষেতের ফসল।
হাতি আর মানুষের এই সংঘাতে হাতি যেমন মারা পড়ছে তেমনি হাতিদের আক্রমনের শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হচ্ছে মানুষকে। এ পর্যন্ত ১৩ জন রোহিঙ্গাসহ মোট প্রাণ হারিয়েছে ২২ জন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সামপ্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত (১৯ অক্টোবর, ২০২০) বৈঠকের সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে, দেশের ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একর বনভূমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এই অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার।
ফরেস্ট ওয়াচ নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরেই উজাড় হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার একর বনভূমি। অর্থাৎ ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত ১৩ বছরে যে পরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়েছে, তার প্রায় দ্বিগুণ উজাড় হয়েছে সর্বশেষ পাঁচ বছরে। এই হারে বনভূমি শেষ হয়ে যেতে থাকলে দেশের বনভূমির পরিমাণ আরও অনেক কমে যাবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু বনভূমি কমে যাওয়া তো নয়। এর সাথে সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল প্রত্যেকটি বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের সেই প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ৫০ বছরেরও কম সময়ে দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৮ শতাংশ প্রাণী হ্রাস পেয়েছে। এর মধ্যে প্রাণী, পাখি এবং মাছও রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই প্রসঙ্গে এটাও বলেছেন যে, বনভূমি উজাড়ের কারণে মানুষের ওপর যে প্রভাবগুলো পড়ছে, তার অন্যতম হলো প্রাণীর শরীর থেকে বিভিন্ন অসুখ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়া। এই বনভূমি উজাড়ের কারণেই ইবোলা, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণী থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়া অসুখ বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, এসব অসুখ ছড়িয়ে পড়া রোধে সত্যিকার অর্থেই ভূমিকা রাখে বনভূমি।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে মোট ১৩০৭টি প্রাণি ও উদ্ভিদকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইনের ৩৬ ধারা অনুযায়ী বাঘ বা হাতি হত্যা করলে ২-৭ বছর কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ১২ বছরের কারাদণ্ড ও ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হবে। আইনের ৩৭ ধারা অনুযায়ী চিতা বাঘ, লামচিতা, উল্লুক, সাম্বার হরিণ, কুমির, ঘড়িয়াল, তিমি বা ডলফিন হত্যা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এই আইনের ৩৮ ধারা অনুযায়ী পাখি বা পরিযায়ী পাখি হত্যা করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। আইনে আরো বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি কারো কাছ থেকে বন্য প্রাণি, বন্য প্রাণির কোনো অংশ, মাংস, ট্রফি বা কোনো দ্রব্য কিনলে সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে।
এই আইনে আরো বলা হয়েছে, সরকারি বন, বনের অংশ, সরকারি ভূমি, জলাভূমি বা যে কোনো এলাকাকে গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা যাবে। অভয়ারণ্যে কেউ চাষাবাদ, শিল্পকারখানা স্থাপন, উদ্ভিদ আহরণ ও ধ্বংস এবং অভয়ারণ্যে কেউ অগ্নিসংযোগ করতে পারবে না। এ সম্পর্কিত বিধিনিষেধ কেউ লংঘন করলে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
পরিবেশ রক্ষা করতে হলে আমাদের রক্ষা করতে হবে হাতিসহ সব বন্যপ্রাণিদের। এবং সেসঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগও জরুরি। বনাঞ্চল ধ্বংস করে রোহিঙ্গা বসতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণির নিরাপদ আবাসস্থল। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবেশে। কাজেই পরিবেশ বাঁচাতে হলে একইসঙ্গে আমাদের বন্যপ্রাণী বাঁচানোর উদ্যোগও নিতে হবে।
বাংলাদেশের বুকে জেঁকে বসা বার্মার রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠালে কিংবা অন্যত্র পুনর্বাসিত না করলে এই বনাঞ্চল রক্ষা করা যাবে না। আমাদের পরিবেশও রক্ষা হবে না। কাজেই এখন সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের তথ্যটিও তুলে ধরা।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রয়োজন সমাজ নিয়ে ভাবনা ও জনসচেতনতা
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম