প্রিয় প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা

রোকসানা বন্যা | বৃহস্পতিবার , ২২ এপ্রিল, ২০২১ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

‘কিছুতেই হিসাব মিলছে না’ – একটি দৈনিকের শিরোনাম দেখে ভাবলাম সত্যিই তো এই আমরা যারা মা, বাবা আছি তারা কতটুকু হিসেব কষতে পারি আমাদের সন্তানদের নিয়ে। প্রত্যেক মা বাবাই তার সন্তানকে সুস্থ, সুন্দর, মানবিক মানুষ করেই গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। যথাসম্ভব সন্তানের সাথে এখনকার অভিভাবকরা খোলামেলা আলাপ আলোচনা করে থাকেন। তাদের গার্লফ্রেন্ড, বয়ফেন্ডের সাথেও সুসম্পর্কটা বজায় রাখে পরিবার। যেন বুঝতে পারে কাদের সাথে চলাফেরা করছে। কিন্তু এ সন্তানেরা পরিবারের চেয়ে অনেকগুণ চালাক হয়ে উঠেছে। এদের সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না পরিবার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বা চাকরি করা ছেলেমেয়েকে তো আর চোখেচোখে রাখা যায় না। একটা বয়স পর্যন্ত তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারে। যতই বড় হয় সন্তান, ততই এই নজরদারি তাদের ইগোতে লাগে। পরিবারের সাথে খারাপ ব্যবহার করা, মোবাইল কন্ট্রার্কে না আসা এ’সব একদিনের ঘটনা নয়। দিনের পর দিন এভাবে চলতে চলতে পরিবারও একসময় হাল ছেড়ে দেয়। সন্তান ব্যস্ত ভেবে চুপ থাকে। আর বারবার সন্তানের কাছে অপমান হতেই বা কে চাইবে?
৩১ জানুয়ারি ইউনিভারসিটিতে পড়া ছাত্রীর যে ঘটনা ঘটেছে এখানে কাকে দায়ী করবো আমরা? আমাদের সন্তান? নাকি সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসন নাকি পারিবারিক অবস্থান?
পুলিশের আইজিপি বলেছেন, সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মেলামেশা করে তা দেখার দায়িত্ব পরিবারের। কতদূর দেখতে পারবে পরিবার? অবাধ মাদক বেচাকেনা, নতুন নতুন মাদকে সয়লাব হচ্ছে দেশ। এসব বেচাকেনা বন্ধ করার দায়িত্বতো আমাদের প্রশাসনের। অথচ তাদের অনেকেই এই ব্যবসার সাথে জড়িয়ে আছেন। এসব দেখভাল রাষ্ট্রের কাজ। কিছু চুনোপুঁটি ধরে, কতশত মাদক আটক করলো তা দেখানোর চেয়ে বরং এদের গডফাদারদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। সরকারের যদি টনক না নড়ে সেখানে পরিবার কিছুই করতে পারবে না। জাতির এক তৃতীয়াংশ ছেলেমেয়ে কোনো না কোনো নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। দারুণ সব মেধার বিলুপ্ত হচ্ছে আমাদের এ সন্তানদের। আমরা মেধা শূন্য জাতি হচ্ছি ক্রমশ।
আমি এমন এক পরিবারকে জানি যার সন্তানও কিছুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে এমন এক পরিস্থিতিতে। এখন প্রায় ছেলেমেয়ে রাত জেগে থাকে। এটাই এখন লেটেস্ট ফ্যাশন তাদের। মুভি দেখা, রাত জেগে ফাস্টফুড খাওয়া, যার যা নেশা সবই এই রাতের অন্ধকারে পরিবার যখন গভীর ঘুমে তখনই করে। সারারাত জেগে থাকে বিধায় সকাল গড়িয়ে, দুপুর গড়ায়ে এদের ঘুম ভাঙে। যার কথা বলছিলাম তার মা খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করলো, দরজা নক করলো, (আমাদের সন্তানেরা দরজা লক্‌ করে রাখে প্রায়। এটা তাদের প্রাইভেসি। এই প্রাইভেসিতে আঘাত করা যাবে না। করলে তুলকালামকাণ্ড সেদিন পরিবারের উপর।) ফোন করলো, কিছুতেই যখন জাগছে না, মায়েরই মন তো সন্ধ্যায় সন্তানের সমস্ত প্রাইভেসি ভেঙে চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখে তার বুকের ধন, আদরের সন্তানের শরীর ঠান্ডা, শক্ত হয়ে আছে। যথারীতি হসপিটাল, ডাক্তার, আর তারপর সবমায়া ছেড়ে নেই হয়ে গেল এই আদরের সন্তানটি। একটা সন্তানের মৃত্যু পরিবারের জন্য কতটা কষ্টদায়ক হতে পারে, একটা পরিবার কতটুকু নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, তা যদি অন্য সন্তানেরা বুঝতে পারতো, তাহলে তারা এমন উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে যেতে পারতো না। কিন্তু এসব বোঝার বোধশক্তিও বিলুপ্ত হচ্ছে তাদের।
আমরা অভিভাবকরা সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব করে কি বেশি ক্ষতিই করে ফেলেছি? কোনো পরিবার তো এমন কোনো কু’শিক্ষা কখনও দেয় না। অনেকেই বলে পরিবারের শিক্ষার অভাব। বেশি আদরে এমন করেছে। মা- বাবা তো আদর করবে তার সন্তানকে। পাশাপাশি আলাপে বুঝিয়ে দেয় কোনটা খারাপ আর কোনটা ভালো। একসাথে বসে আড্ডা দেয়া, মুভি দেখে ভালোমন্দের শিক্ষা দেয়ারও চেষ্টা করে। এসব শুনলে বোকার হাসি পায় আমার। এখনকার সন্তানদের তো বকাও দেয়া যায় না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সে যথেষ্ট ম্যাচুয়েড।
ছোটবেলায় আমাদের মা,বাবারা এসবের ধার ধারেনি। যখন তখন বকে দিতো অন্য মানুষের সামনে। আমাদের ইগোতে লাগলেও ভয়ে আমরা বলার সাহস রাখিনি। সে’সবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মেলামেশা করতে দিয়েছেন তা সীমাবদ্ধতার মধ্যে। রাতবিরাত যখন তখন বাইরে যেতে দেয়নি। প্রতিবাদ করার সাহস ছিলো না। করলেই মাইর খেতে হয়েছে। আমরা ভয় পেয়েছি বড়দের, অসম্মান হোক তেমন কিছুই তাঁদের সামনে করার সাহস হতো না। আর এখন কত ছোট ছোট ছেলেদের দেখি বড়দের সামনে সিগারেট ফুঁকছে। ওদের আড়াল করে বরং বড়রাই সরে পড়ছে। এতো দ্রুত পাল্টে গেলো সব- অবাধ স্বাধীনতার নামে, ভাবলেই কষ্ট লাগে খুব। সন্তানকে সর্বস্ব দিয়েই মানুষ করতে চেষ্টা করে প্রত্যেক পরিবার। যারা অমানুষ হয়েছে এটা পরিবারের দোষে নয়।
আমরা ভাবতেও পারি না কখন, কিভাবে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলেমেয়ের খপ্পরে পড়ে পরিবারের একজন মেধাবী, ভদ্র সন্তানটিও একসময়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মন মানসিকতা বদলানো কঠিন কিছু নয়। পজেটিভ মানুষের কথা চিন্তা করলে নিজেরাই একদিন পজেটিভ হয়ে উঠবে। মা হয়ে এমন আশা করতেই পারি প্রিয় প্রজন্মের কাছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছোটবেলা থেকে সন্তানকে যেনো ভালো মানুষ হবার মন্ত্র শেখাই
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল