গণতন্ত্র এবং শুদ্ধ রাজনীতি সমকালে ধুঁকছে বিশ্বব্যাপী। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডে মোটামুটি শুদ্ধ গণতন্ত্র চর্চা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে তা ক্ষতদুষ্ট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোসহ নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়ও মোটামুটি সুস্থ সবল গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে। তুলনায় বিশ্ব পরাশক্তি ও জাতিসংঘের মূল নীতিনির্ধারক নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ‘পঞ্চ পাণ্ডবে’র দুটোতেই গণতন্ত্র নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রল কলেজ গণতন্ত্রও ভঙ্গুর। রাশিয়ায় নিয়ন্ত্রিত এবং চীনে একদল ও ব্যক্তির শাসন চলছে। আরেক পরাশক্তি ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে টিকে থাকলেও সামপ্রদায়িক উগ্রতা ও সিস্টেমের মোটা দাগের ক্ষতগুলো দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। সব অঘটনের দায় অশুদ্ধ ও অস্বাস্থ্যকর রাজনীতি এবং কর্পোরেট ভোগবাদের আছর।
মুসলিম উম্মাহর দেশগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। মুরুব্বি সৌদি আরব থেকে শুরু করে প্রায় সবগুলোতে হয় গণতন্ত্র নেই অথবা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র । সৌদি রাজতন্ত্রতো যুবরাজ সালমান বিন আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পুরো পথ ও আদর্শ বদলে পশ্চিমা সংস্কৃতি চর্চা জোরেশোরে শুরু হয়েই গেছে। দেশটিতে শিগগিরই বারও চালু হওয়ার পথে। আরব আমিরাত বিশেষ করে দুবাই বিনোদন ও পর্যটন নগর হিসাবে পূর্ব এশিয়ার কিছু নগর ও মার্কিন বিনোদন নগর লা ভেগাসের সাথে পাল্টা টানছে। আরব মুল্লুকে এত দ্রুত পট পরিবর্তন হবে, ইসলামি খোলস খুলে পুরোই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে ভেসে যাবে, দশক আগেও ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু ঘটছে! রাজা বাদশাহ বা আমিরতন্ত্রের নাগরিকেরা মেনেও নিচ্ছে চুপচাপ। তুলনায় বাংলাদেশসহ এ’ অঞ্চলের বেশ কটি দেশে বাড়ছে ভয়ঙ্কর ধর্মান্ধতা। মানে আরব জাহানের ঠিক উল্টোচিত্র। কাবুলে তালেবান উত্থানের পর অবস্থা আরো গোলমেলে হয়ে গেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ধর্মান্ধতা ও দুর্নীতি এখন জোড়াশব্দ! ধর্মান্ধ সবগুলো দেশেই দুর্নীতির শিকড় বাকড় খুবই মজবুত। যে সব দেশ দ্রুত উন্নতির চুড়োয় উঠেছে, সবগুলোতেই ধর্ম আড়ালে-আলো ছড়ায় সত্য। এতে দুর্নীতিকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কাছের উদাহরণ সিঙ্গাপুর। বিশ শতকের প্রথমার্ধের জেলেপল্লীটি কিনা এখন এশিয়ার সবচে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ। পুরো এশিয়ার সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক হাব। দেশটির মহান জনক লি কুয়ান ইউ মিথ্যা, দুর্নীতি ও ধর্ম ত্রয়ীকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে একদম বিয়োগ করে দেন। শুধু ম্যাজিকটি ব্যবহার করে কয়েক হাজার ‘‘গরীব জেলেপল্লীর’ সিঙ্গাপুর এখন ৬৫ লাখ জনসংখ্যার বিস্ময়কর সমৃদ্ধ নগররাষ্ট্র। দক্ষ জনসম্পদ ও নাগরিক সচেতনতাও দেশটির উন্নতির অন্যতম অবকাঠামো। দল বেশ কটি থাকলেও নামেমাত্র। লি কুয়ানের দলই ঘুরে ফিরে ক্ষমতায় থাকছে। এ নিয়ে চিল্লা হল্লা নেই, দলাদলি নেই। জনশৃঙ্খলা বিরোধী কিছু করার সুযোগও দেশটিতে নেই।
দুর্ভাগ্য, আমরা আজব ফেন্টাসির জগতে বাস করছি। ব্যক্তিগতভাবে যা চর্চা করিনা, বিশ্বাস করিনা, তাই চাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা সরকার থেকে। হয় নাকি? সমপ্রতি পশ্চিমা বিশ্ব এমন ক’জন নেতা পেয়েছে, যারা প্রকৃতপক্ষেই দেশের খাদেম। এরা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার ও দলের পদাধিকারীদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারেন। যদি রাজনীতিকে শোধন করার আগ্রহ থাকে।
এদের একজন জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর এন্েজলা মার্কেল। ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ টানা ১৮ বছর ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ) নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার টানা ১৬ বছর জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসরে গেছেন। অবসরে যাওয়ার দিন পুরো ৮ কোটি জার্মানবাসী ৬ মিনিট যে যেখানে ছিলেন দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে তাঁকে শেষ বিদায় জানান। ঘরে যারা ছিলেন তারাও বাড়ির বেলকনি বা টেরেসে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে মার্কেলের প্রতি বিরল সম্মান দেখান। অভূতপূর্ব এক বিদায়ী সংবর্ধনার স্বাক্ষী হলো বিশ্ববাসী। কোয়ান্টাম রসায়নে ডক্টরেট এন্েজলা মার্কেল জার্মানিকে ইউরোপের সবচে বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে তুলে আনেন। সাধাসিধে জীবন চর্চায় অভ্যস্ত মার্কেল চ্যান্সেলর হওয়ার আগে সাধারণ ফ্ল্যাটে থাকতেন। চ্যান্সেলরের পুরো মেয়াদেও সেখানে ছিলেন তিনি। তাদের কোন গৃহকর্মী ছিলনা, স্বামী স্ত্রী মিলে সব গৃহস্থালি কাজ করতেন। এমন কি ওয়াশিং মেসিনে কাপড় ধোয়া পর্যন্ত। নিজের কোন আত্মীয়কে সরকারি দায়িত্ব দেননি। একই স্যূট পরে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও বিদেশি নেতাদের সাথে বসতেন। এনিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমি রাষ্ট্রের চাকর, মডেল নই যে ঘন ঘন পোশাক পাল্টাতে হবে। রাষ্ট্রের টাকায় বিলাসিতার সুযোগ আমার নেই। তিনি ফটো সেশন, এঙপোজারের বাইরে থাকেন। দেশের স্বার্থে ১৬ বছরে চুল পরিমাণও আপোস করেননি। চ্যান্সেলর পদ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তার কোন ফ্ল্যাট বা বাড়ি, রিসোর্ট, ইয়ট, ব্যক্তিগত জেট, জমি কিছুই ছিলনা। কখনো কটু কথা বলেননি। ভূষিত হন, ‘লেডি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ খেতাবে। তার কর্মশক্তি ও উদ্দীপনাকে ৬০ লাখ মানুষের সমান বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কেল ছাড়াও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা এ্যর্ডার্ণ সমকালের আরেক কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক। কানাডার জাস্টিন ট্রুডোও কম যান না। এদের দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি ভালোবাসা, ইসলামের প্রথম সুবর্ণ যুগ খেলাফত শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
তুলনা করুন এবার, দেশ ও মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি। ক্ষমতা দখল আর অপব্যবহারে মুসলিম উম্মাহর দেশগুলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। দেশেও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির অবক্ষয় ও পচন ভয়ঙ্কর। প্রতিপক্ষের অভাবে সরকারি দলেও ‘অঙ্গ প্রত্যেঙ্গ’ গুলো লড়াই করছে নানা গ্রুপ, অণুগ্রুপে ভাগ হয়ে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যা ঘটেছে, তাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে দেশের সাধারণ মানুষ। এমন নিষ্ঠুর অসংখ্য বর্বরতাও স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ শিকেয় তুলে রেখে ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থের অন্ধকুপে বন্দী হয়ে গেছে ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতি। সামনে নেই কোন আদর্শিক বাতিঘর। দ্রুততম সময়ে পদ, ক্ষমতা, অর্থ বিত্ত হাতিয়ে নেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। অন্যদিকে যেকোনোভাবে সরকার হঠাতে ধর্মীয় অনুভূতির আগুনে বারুদ দেয়াসহ অন্ধকার চিপা গলিতে মানবিকতা ও সত্যকে পিষে মারছে, ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো। ইসলামসহ পৃথিবীর কোন ধর্ম অন্যায় ও কপটাচার বা অশুভ শক্তিকে ন্যূনতম প্রশ্রয় দেয়না। কিন্তু ঘটছে উল্টো। আমরা ভুলে গেছি, বিপুল রক্তদামে অর্জিত প্রিয় দেশটি আমাদের সবার। সবার সুখ- শান্তি, সুশৃঙ্খল ও মুক্তিযুদ্ধের নির্যাসপুষ্ট দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীই দেশের সবচে’ বড় সম্পদ। এই সম্পদ গড়ে তোলা, সেবা শুশ্রুষা দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট ও স্বাস্থ্যবান করে তোলা রাজনৈতিক দলসহ পেশাজীবি ও কর্পোরেট নেতাদের নৈতিক দায়। দায় ভুলে বা মুছে ফেলে আমরা যদি আত্মস্বার্থে দেশের স্বার্থ টানা বলি দিতেই থাকি, ইতিহাস কিন্তু কখনো ক্ষমা করবেনা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।