(প্রথম পর্ব)
কোথা থেকে, কীভাবে শুরু করবো ভাবছি । লিখতে বসেছি উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের কথা। শিরোনামে ‘প্রায়’ লেখার কারণ হলো শুরুটা টেকনাফ থেকে নয় তবে তার কাছাকাছি চট্টগ্রাম শহর থেকে।
কয়েক বন্ধু মিলে কথা হচ্ছিল। মাঝখানে আমি বললাম আমিও যাবো। আমার খুব ইচ্ছে রংপুর যাওয়ার। কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত হলো ঈদের পর যাবে। আমিও রাজি। কোথাও বেড়াতে যাবার কথা শুনলেই খুশিতে আটখানা হই। দু’দিনের মধ্যেই যাত্রার প্রস্তুতি হয়ে গেলো। আমি বলেছিলাম রংপুর গেলে আমাকে পীরগাছা নিতে হবে। আমার জীবনসঙ্গী বাদলের বেড়ে ওঠার জায়গাটা দেখবো। রাজি হলো এজাজ ভাই।
একদিন ভোর ৭ টায় শুরু হলো আমাদের যাত্রা। ইউএস বাংলা ফ্লাইট সাড়ে আটটায় ছাড়ার কথা। সেটা দেরি হলো ছাড়তে। প্রায় ১০ টায় আমাদের প্লেন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়লো। ঢাকা থেকে কানেক্টিং ফ্লাইট সৈয়দপুর। সে ফ্লাইট আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলো তা আমরা প্লেনে ওঠার পর বুঝতে পারলাম যাত্রীদের হট্টগোলে। সবচেয়ে মজা লাগলো যে ফ্লাইটে ঢাকা গেছি, তা থেকে নেমেই পাশের ফ্লাইটে উঠলাম। এক প্লেন থেকে অন্য প্লেনে। লাগেজগুলো খুব তাড়াহুড়ো করে নামানো হলো। আমরা ওঠার পর প্লেন ছাড়লো। আমরা সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে নামলাম। ছোট্ট এয়ারপোর্ট। তবে ছিমছাম। বেশ যাত্রী দেখলাম আসা–যাওয়া করছে।
ঢাকা থেকে সৈয়দপুর যাওয়ার পর সেখান থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার প্ল্যান। আসলে আমাদের কোন প্ল্যান নেই। এজাজ মাহমুদই এই ভ্রমণের উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারী। ফলে তার মাথাতেই ম্যাপ করা আছে পুরো যাত্রাপথ আর যাবতীয় পরিকল্পনা।
আমাদের জন্য এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি অপেক্ষায় ছিলো। প্রথমে গেলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা দেখতে। রেলওয়ে কারখানাটা খুবই সুন্দর। একদম ঝকঝকে। আদলটা যাদুঘরের মতো। পুরোনো ইঞ্জিন, দেড়শো বছর পুরোনো একটা বড় ঘন্টা এখনও যত্ন করে রাখা আছে।
ক্লান্ত, শ্রান্ত মন নিয়ে আমরা পৌঁছালাম রংপুর পুলিশ রেস্ট হাউজে। ওখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন রংপুরের পুলিশ কমিশনার নুরে আলম মিনা ভাই। তিনি খুবই নম্র, ভদ্র আর একজন জনপ্রিয় মানুষ । ফ্রেস হয়ে দুপুরের খাবার খেলাম তৃপ্তি ভরে। বিকেলে আমরা রংপুর শহরে ঘুরতে বের হলাম। প্রথমেই গেলাম ঘাগট নদীর পাড়ে একটি পার্কে। এটা সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত।
পড়ন্ত বিকেলের মুহূর্তে ঘাগট নদীর দু’পাড়ের দৃশ্য দেখার মতো।
রংপুরে নিসবেতগঞ্জ রোড়ে অবস্থিত এই পার্কটি ১১০০ একর জমির উপর অবস্থিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০১৩ সালে ঘাগট নদীর দু’পাড়ে গড়ে তোলে এই সুন্দর পার্কটি। এই পার্কে উপার্জনের ৭৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী কল্যাণে ব্যয় হয়। ডাইনোসাররের আকৃতিতে পার্কের মূল ফটক।
এরপর গেলাম শতরঞ্জি পল্লী। ওদের শিল্পকর্ম, বুননের কাজ আমাদের মুগ্ধ করেছে। কারখানাও ঘুরে দেখলাম।
তারপরে গেলাম বেসরকারি উদ্যেগে নির্মিত চিকলি ওয়াটার পার্ক।
রংপুরের হনুমানতলা এলাকার শত বছরের প্রাচীন চিকলী বিল। চিকলি বিলের পাশেই গড়ে উঠেছে চিকলি ওয়াটার পার্ক। জায়গাটা সুন্দর এবং বেশ বড়। বসার পর্যাপ্ত জায়গা, স্বাচ্ছন্দে সময় কাটানো যায়।
চিকলি ওয়াটার পার্ক এর মূল আকর্ষণ ঝরনা। রাতে এই ঝরনা দেখতে বেশি ভালো লাগে। নানা রঙের আলো ঝরনার সৌন্দর্যকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলে। খুব অল্প সময়েই আমাদের মন কেড়ে নিয়েছে চিকলি ওয়াটার পার্কের এই দৃশ্য।
রঙিন পানির ফোয়ারা। এখানে বিভিন্ন রঙের লাইট সেট করে দেয়া আছে। লাইটের রং কিছুক্ষণ পর পর পরিবর্তন হতে থাকে যার ফলে জলেও বিভিন্ন রং ধারণ করছে।।
ছোট ছোট পাতাবাহারের গাছ। গাছের সামনে বিভিন্ন রঙের লাইট। রাতে পাতার রঙ এতো সুন্দর দেখায় যে, আসল রঙ দেখতে পাওয়া মুশকিল। এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশে এমন, এতো বিশাল পার্ক আছে বলে মনে হয় না। মনে হবে থাইল্যান্ডের কোন এক বিনোদন পার্কে ঘুরছি।
বর্তমানে চিকলির বিল দু’ভাগে বিভক্ত। বিলের দক্ষিণে গড়ে উঠেছে ওয়াটার পার্ক। সেখানে আছে বিভিন্ন ওয়াটার রাইড। আর বিলের উত্তর পাশ যার নাম চিকলি ওয়াটার গার্ডেন। যার প্রবেশ মূল্য ৩০ টাকা।
বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা চিকলি বিনোদন পার্কের পাশেই আছে রিসোর্ট। আছে ৫টি সিটিং এরিয়ার রেস্টুরেন্ট। সেখানকার বিশালকার চরকিতে চড়ার সুযোগ হয়েছিলো। পড়ন্ত এক বিকেল কাটানোর জন্য অসাধারণ এক স্থান এই চিকলির বিল। ভাবছিলাম আমাদের শহরেও এমন একটা বিনোদন পার্ক হতে পারতো।
রংপুরের দ্বিতীয় দিন আমাদের যাবার কথা পীরগাছা। জানানো হলো এই শহরে দেখার রয়েছে অনেক। শুনলাম কারমাইকেল কলেজ কাছেই। আমার দেখার আগ্রহ বাড়লো। আমি আমার ভাসুরের মুখে অনেক শুনেছি এই কলেজের গল্প। সিদ্ধান্ত হলো আগে কারমাইকেল কলেজ দেখবো।
কারমাইকেল কলেজ অনেক বিশাল এলাকা নিয়ে। লর্ড ব্যারন কারমাইকেলের নামানুসারে এর নাম। সুন্দর জায়গা। সবুজ অরণ্য বলা যায়। বলা যায় অসাধারণ। এত সুন্দর পরিবেশ। ওহ্ !
অবাক হলাম এতো বিশাল জায়গা জুড়ে এই কলেজ। বাদল লাল বিল্ডিং খুঁজছিলো। তার স্মৃতিতে লাল বিল্ডিংই ছিলো মূল ভবন। অনেক খুঁজেও পেলাম না সে ভবন। পরে শুনেছি তার রঙ পাল্টিয়েছে।
কারমাইকেল কলেজ থেকে গিয়েছি তাজহাট রাজবাড়ী। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ–রাজবাড়িটি ব্যবহৃত হয় রংপুর হাইকোর্ট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একটি শাখা বা বেঞ্চ হিসেবে। যার উদ্বোধন করেন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। এটির চারপাশ দারুণ। পার্কের মত। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রাসাদটিকে একটি সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করে। রাজবাড়ির ভেতরটা দেখা হলো না আমাদের ।
পথে পড়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, তাও ঘুরে গেলাম। তারপর গেলাম পায়রাবন্দ। এই পায়রাবন্দ রংপুর শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। যেখানে নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। মিঠাপুকুর উপজেলার পাযয়রাবন্দ নামক গ্রামে তাঁদের সে জমিদার বাড়ি। বেগম রোকেয়ার পিতা ছিলেন পায়রাবন্দের জমিদারীর সর্বশেষ উত্তরাধিকারী। তার মাতা ছিলেন বনিয়াদী জমিদার বংশের কন্যা।
বেগম রোকেয়ার বাড়িতে এখন আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই । যা আছে তা হলো শুধু ভাঙা দেয়াল ও খুঁটি যা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এই পায়রাবন্দের কথা পড়েছি বইয়ে। মন ভরে দেখে নিলাম নারী জাগরণের পথিকৃতের এই স্তম্ভ।