প্রসেনিয়াম : বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব

জ্যোতির্ময় নন্দী | শুক্রবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২০ at ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

হঠাৎ করেই চলে গেলো প্রিয় বন্ধু শান্তনু বিশ্বাস– নাটকপাগল, গানপাগল, কবিতাপাগল শান্তনু। কর্মে বিশ্বাসী শান্তনু তার অনতিদীর্ঘ জীবনে যা করার মোটামুটি করে গেছে, তবে তার কিছু কাজ অসমাপ্তও থেকে গেছে, তার আকস্মিক, পূর্বাভাসহীন অকালমৃত্যুর কারণে। এসব শেষ না হওয়া কাজের অন্যতম ছিলো বিগত শতকের আশি আর নব্বইয়ের দশকে তার সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে বেরুনো ‘প্রসেনিয়াম’ নামের নাট্যপত্রিকাটির সবকটি সংখ্যাকে একই মলাটের মধ্যে একটি বৃহদায়তন গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশনা। শান্তনুর সুযোগ্যা স্ত্রী, সু-অভিনেত্রী শুভ্রা বিশ্বাস তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতেই গ্রন্থটি প্রকাশ করে তাঁর প্রয়াত স্বামী ও নাটকের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় প্রেম ও নিষ্ঠার পরিচয় আরেকবার নতুন করে দিলেন।
নাট্যাভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, নাট্যদলপতি, নাট্যপত্রিকা সম্পাদক– নাটকের সঙ্গে সর্বতোভাবে, ওতপ্রোতভাবে জড়িত শান্তনু বিশ্বাস সক্রিয় অবস্থাতেই হঠাৎ হৃদ্‌যন্ত্রবৈকল্যে মারা গেলেন ২০১৯-এর ১২ জুলাই। ‘শান্তনু বিশ্বাস সম্পাদিত প্রসেনিয়াম’ নামের সঙ্কলনটি বেরুলো ২০২০-এর জুলাইয়ে।
শান্তনুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ২০১৯-এর একুশে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড় মোড়ে প্রকাশনা সংস্থা ‘খড়িমাটি’র অনুষ্ঠানে। মনে আছে, তখন সে বলেছিলো, “প্রসেনিয়ামের সবকটা সংখ্যা একসঙ্গে পুনর্মুদ্রণ করছি, একটা সঙ্কলন হিসেবে, যাতে যে কেউ চাইলে পড়তে পারে।”
আমাকে সে কথাটা বলেছিলো পুরোনো বন্ধু প্রসেনিয়াম নাট্যপত্রিকার গোড়ার দিকে জড়িত একজন হিসেবে। ‘একটি ষান্মাসিক পত্রিকা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়ে ১৯৮৩’র মার্চে যখন প্রসেনিয়াম প্রথম সংখ্যা যখন প্রকাশিত হলো, সহযোগী হিসেবে শান্তনু আমাকে আর বিশ্বজিৎ চৌধুরীকে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত করেছিলো। যতই যুক্ত করুক, প্রসেনিয়াম যে মূলত শান্তনুর ‘ওয়ান-ম্যান শো’ ছিলো সেটা স্বীকার করতে হবে। শান্তনু তখন সবেমাত্র অ্যাপ্রেন্টিস টি-টেস্টার হিসেবে ইস্পাহানিতে যোগ দিয়েছে, এবং স্বয়ং ইস্পাহানি প্রতিষ্ঠাতা অশীতিপর মির্জা আহমদ ইস্পাহানির কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। অফিসের বাইরে যে-সময়টুকু পেতো সবটাই সে লাগিয়েছিলো প্রসেনিয়ামের পেছনে। তখন মোবাইল ফোন ইন্টারনেটের যুগ নয়। চিঠিতে বা ল্যান্ডফোনে শহরের, দেশের বা দেশের বাইরের কন্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেখাপত্র সংগ্রহ, নির্বাচন, সম্পাদনাসহ পত্রিকাটির মুদ্রণ, বাঁধাই, পরিবেশনা ইত্যাদির জাতীয় দায়দায়িত্ব ও খরচ শান্তনু একাই বহন করতো। আমরা সহযোগীরা সম্পাদনা, রিভিউ লেখা, প্রুফ সংশোধন, অনুবাদ ইত্যাদিতে কিছু সাহায্য করেছিলাম মাত্র।
এভাবে প্রসেনিয়াম প্রথম সংখ্যা বেরুনোর পর ছয়মাস ব্যবধানে দ্বিতীয় সংখ্যা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো যথেষ্ট লেখার অভাবে। তখন শান্তনু আমাকে প্রস্তাব দিলো ইংরেজি থেকে একটা নাটক অনুবাদের, যাতে দ্বিতীয় সংখ্যায় সেটা সে ছাপাতে পারে। এটুকু মনে আছে যে, যদিও ইংরেজি থেকে সাহিত্যিক অনুবাদের আমার তেমন কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিলো না বা নিজের ইংরেজি জ্ঞানের ওপরেও তেমন ভরসা ছিলো না, তবুও শান্তনুর একান্ত অনুরোধে কাজটা করতে রাজি হয়ে গেলাম। সে জোরগলায় বললো, ‘তুমি পারবে!’
এবং আমি সত্যিই পেরে গেলাম। ‘নিয়তি নির্দিষ্ট মানুষ’ নামে নাটকটির অনুবাদ শান্তনুর পছন্দ হলো। ছয়মাস নয়, নয়মাস পর, ১৯৮৩’র ডিসেম্বরে প্রসেনিয়ামের দ্বিতীয় সংখ্যা বেরুলো অনূদিত নাটকটিকে বৃহত্তম রচনা হিসেবে নিয়ে। অনেক পরে, সম্ভবত নব্বই দশকের শেষের দিকে শান্তনু তার প্রতিষ্ঠিত ‘কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়’-এর ব্যানারে ‘মানুষ ও নিয়তি’ নামে নাটকটি মঞ্চস্থ করে। শান্তনু বিশ্বাস পরিচালিত এই নাটকটিতে দুই কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করেছিলো শান্তনু নিজে এবং তার স্ত্রী শুভ্রা। এর পর শান্তনু আমাকে অনুবাদ করতে দেয় আন্তন চেখভের ‘সী-গাল’ নাটকটি। নাটকটি আমি সরাসরি অনুবাদ না করে উপামহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে রূপান্তর করি বা করার চেষ্টা করি। প্রয়াসটি ‘গাংচিল’ নামে প্রকাশিত হয় প্রসেনিয়াম চতুর্থ সংখ্যায়।
প্রসেনিয়ামে আমার নাটক অনুবাদ নিয়ে এ কথাগুলো বললাম আমার নিজের ঢাক পেটানোর জন্যে নয়, মানুষকে সত্যিকারের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, প্রণোদনা যুগিয়ে সৃজনক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে শান্তনু বিশ্বাস কতটা পারঙ্গম ছিলো সেটা বোঝানোর জন্যেই। অনুবাদক হিসেবে আজ যদি আমার কিছু পরিচিতি বা সুনাম হয়ে থাকে, তার পেছনে বন্ধু শান্তনু বিশ্বাসের খানিকটা অবদান আছে বইকি।
এভাবেই আমাকে দিয়ে, কবি-কথাশিল্পী বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি শাহিদ আনোয়ার, অধ্যাপক মাইনুল হাসান, অধ্যাপক ড. কুন্তল বড়ুয়া এবং আরো অনেককে দিয়ে লিখিয়ে, অনুবাদ করিয়ে তিল তিল করে উপকরণ যোগাড় করে প্রসেনিয়ামের সাতটা সংখ্যাকে সাজিয়েছে শান্তনু, সম্পূর্ণ তার একক উদ্যোগে। প্রসেনিয়ামের প্রয়োজনে একদিকে সে প্রবীণ যশস্বী কথাশিল্পী ও নাট্যকার সুচরিত চৌধুরী, জনপ্রিয় কথাশিল্পী ও নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদ, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নাট্যকার অধ্যাপক কার্তিক লাহিড়ী, নাট্যকার সেলিম আল দীন, প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক আবুল মোমেনের মতো প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা সংগ্রহ করেছে নানা কৌশলে ও চেষ্টায়। অন্যদিকে তখনও নেহায়েতই ছাত্র বা কর্মজীবনে আদৌ পা না রাখা আমাদের মতো লিটল ম্যাগাজিনে কলম চালানোদেরকে দিয়েও সে নানা লেখা লিখিয়ে নিয়েছে। নিজের কর্মস্থলে ক্রমোন্নতি ও দায়িত্বের ক্রমবর্ধমান চাপ সত্ত্বেও নাটকের প্রতি শান্তনুর বিপুল ভালোবাসা ও নিষ্ঠাই তাকে এ কঠিন শ্রম ও মেধাসাধ্য কাজে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
কিন্তু তারপরও একসময় তাকে থামতেই হয়েছে, যার কারণ হিসেবে শান্তনু লেখার অভাবের কথা বলেছে। ১৯৮৯ (১৩৯৬ বাংলা)-এ প্রসেনিয়াম ষষ্ঠ সংখ্যা বেরুনোর পর সাময়িকীটির অনিয়মিত প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। সুদীর্ঘ তিন দশক পর, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় প্রসেনিয়াম সপ্তম সংখ্যা।
পত্রিকাটির ‘প্রসেনিয়াম’ নামটিও শান্তনুই ঠিক করেছিলো। ‘প্রসেনিয়াম’ শব্দটা মূলত লাতিন, যেটা আবার এসেছে গ্রিক শব্দ ‘প্রস্কেনিয়ন’ থেকে। শব্দটার আভিধানিক অর্থ হলো নাটকের ‘সিন’ বা দৃশ্যের পুরোভাগে, অর্থাৎ পর্দার বাইরে মঞ্চের সামনের দিকে একটা বাড়তি জায়গা, যেটা মঞ্চের সমতলে, কিছুটা নিচে, বা একেবারে দর্শকদের সমতলে হতে পারে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে প্রসেনিয়ামযুক্ত মঞ্চ বা সংক্ষেপে প্রসেনিয়াম মঞ্চ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। পাথরে গড়া গ্রিকো-রোমান মঞ্চের ধ্বংসাবশেষ এখনও পাওয়া যায়।
মূলত নাটকের শুরুতে উপস্থাপক বা নান্দীপাঠক, ধারাভাষ্যকারী বা সূত্রধার প্রমুখ মঞ্চের এই প্রসেনিয়াম অংশটি ব্যবহার করতো। অনেক সময় চলমান নাটকের অভিনেতাদের কেউও প্রসেনিয়ামে নেমে এসে দর্শকদের আরো কাছে বা ভেতরে চলে আসতো। প্রসেনিয়াম হলো মঞ্চের কল্পজগত এবং দর্শকদের বাস্তব জগতের মধ্যেকার একটি যোগসূত্র।
গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে ব্রেখ্‌ট্‌ ব্যাপকভাবে বাংলায় অনূদিত হচ্ছিলো, নান্দিকার প্রভৃতি নাট্যদলগুলো যখন সেগুলো মঞ্চস্থ করছিলো, বাদল সরকার, মনোজ মিত্র প্রমুখ যখন ব্রেখটীয় আঙ্গিকে নাটক লিখছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর সে-জোয়ারের পানি বাংলাদেশেও ঢোকে হুড়মুড়িয়ে। ঢাকায় থিয়েটার, নাগরিক, ঢাকা থিয়েটার প্রভৃতি দলগুলো ব্রেখটীয় অনুবাদের বা আঙ্গিকের নাটক মঞ্চস্থ করতে থাকে। ১৯৭৩-এ চট্টগ্রাম কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক, বিশিষ্ট নাট্য রচয়িতা, পরিচালক, অভিনেতা মমতাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে থিয়েটার ৭৩ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্রেখটীয় ধারা অনুসারী নাট্য প্রযোজনা চট্টগ্রামেও আবির্ভূত হয়। অচিরেই গণায়ন, অরিন্দম প্রভৃতি বিভিন্ন নবপ্রতিষ্ঠিত নাট্যদল নাটকে প্রসেনিয়াম মঞ্চের ব্যবহার করতে থাকে।
শান্তনু নিজে ছিলো গণায়নের সদস্য ও অগ্রণী অভিনেতা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ প্রায় আটমাস কলকাতায় শরণার্থী থাকাকালে সে বহুরূপী, নান্দিকার, পিএলটি প্রভৃতি দলের নাটকে প্রসেনিয়ামের ব্যবহার খুব কাছ থেকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে। এ বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছে। তবে যদিও সে প্রসেনিয়ামের প্রেমে মজেছিলো, কিন্তু তার যে দেশীয় আঙ্গিকের মিশেলে মঞ্চ সম্পর্কে প্রসেনিয়াম থেকেও প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনা ছিলো, তা জানা যাবে প্রসেনিয়াম পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যায় তার লেখা সম্পাদকীয় থেকে।
আশির দশকে এক সামরিক স্বৈরাচারী শাসনামলে প্রসেনিয়ামের প্রকাশনা শুরু হয়েছিলো। পরবর্তী প্রায় দু দশক জুড়ে প্রসেনিয়ামের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালে সে-অবস্থার তেমন কোনো ইতরবিশেষ হয় নি। এই ক্রান্তিকালে নাট্যচর্চার সার্বিক দুরবস্থা, তা থেকে উত্তরণের উপায়, নাটকের তত্ত্বীয় ও অঙ্গিক নিয়ে শান্তনু বিশ্বাসের নানা চিন্তাভাবনা, নিবন্ধ, তার লেখা মৌলিক নাটক প্রভৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রসেনিয়ামের বিভিন্ন সংখ্যাগুলোতে। আমার অকালপ্রয়াত এই প্রতিভাবান বন্ধুকে জানতে হলে, এই প্রসেনিয়াম সঙ্কলনই হতে পরে তার প্রধান আকরগ্রন্থ। শান্তনুর আক্ষরিক অর্থেই সহধর্মিণী শুভ্রা বিশ্বাসকে আমরা সবিনয় অনুরোধ জানাবো, ‘শান্তনু বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত’ কথাটি নামলিপিতে চিরস্থায়ীভাবে মুদ্রিত করে প্রসেনিয়াম পত্রিকাটির পুনঃপ্রকাশ শুরু করা হোক, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের মান ও রুচির প্রতিফলন অব্যাহত রেখে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহিমোফিলিয়া সোসাইটিকে লায়ন্স ক্লাবের কম্পিউটার প্রদান
পরবর্তী নিবন্ধঘরে ফেরা ঘর