প্রসঙ্গ : নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি

আলেয়া আরমিন আলো | শুক্রবার , ১২ মার্চ, ২০২১ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সভ্যতা ও প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রগোতিশীল হচ্ছে আমাদের সমাজব্যবস্থা। কিন্তু তার সাথে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি কতটুকু মিলেছে, বা নারী অর্থনৈতিকভাবে কতটা স্বাধীন হয়েছে তা কয়েকটি ঘটনার বর্ণনায় আলোকপাত করছি।
ঘটনা-১ : রাহেলা খালার বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি। সে গত ২৮ বছর ধরেই শহরের অভিজাত ফ্যাটগুলোতে ছুটা বুয়ার কাজ করে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে মা। ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে যার যার সংসারজীবনে ব্যস্ত। রাহেলার স্বামীর বয়সও সত্তরের কাছাকাছি। সে শহরের অলিগলিতে কলা ফেরী করে বেড়ায়, তাতে তেমন আয় হয় না। কিন্তু রাহেলা খালার মাসিক আয় মোটামুটি তার স্বামীর চেয়ে তিনগুণ বেশি। স্বামীর উপার্জিত সামান্য অর্থে মাঝেমধ্যে শুধু শাকসবজি ও পান কেনা হয়। এরমধ্যে সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বেশিরভাগ দিনই রাহেলা রান্নার জন্য ঠিকমত বাজার-সদাই পায় না। স্বামীকে কিছু বললেই বলে, আইজ আমি কলা বেইছবার যাই নাই। শরীরলডা বালা না। তুই ট্যাহা দে বাজার কইরা আনি। রাহেলা টাকা দিতে না চাইলেই এই বুড়ো শরীরের উপরে লাথি ঘুষি খেতে হয়। কান অতিষ্ঠ করা অশ্রাব্য গালিগালাজেও শুনতে হয়। বাধ্য হয়েই সে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দিতে দেয়। তার স্বামী সপ্তাহে তিন থেকে চারদিনই কলা বিক্রি করতে না গিয়ে ঘরে আরাম করে। সামান্য অসুখ বিসুখেও অবসর নেয়, রাহেলার টাকায় চিকিৎসাও করায়। কিন্তু রাহেলার কোন অবসর নেই,রোদবৃষ্টি মাথায় সে কেবল ছুটে আর ছুটে… তবুও নিজের উপার্জিত অর্থ খরচের স্বাধীনতা নেই রাহেলার।
ঘটনা-২ : ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করা নীলার আট বছর আগে বিয়ে হয় রাতুলের সাথে। রাতুল একটা প্রাইভেট ব্যাংকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বিয়ের পরপর স্কুল কলেজে চাকরির চেষ্টায় বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ দিয়েছে নীলা। কারণ রাতুল চায় নীলা কেবল শিক্ষকতার পেশাটাই বেছে নিক। একবার ব্যাংকে একটা জব হয়ে গেলেও রাতুলের পরিবার আপত্তি তোলে। মেয়েমানুষ সকাল দশটা থেকে রাত নয়টা অফিস করলে সংসার দেখবে কখন? অবশেষে রাতুল ও তার পরিবারের মন রক্ষা করা ছাড়া নীলার জীবনে আর কিছুই করা হলো না। এর মধ্যেই ছেলেমেয়ের জন্ম হলে নীলাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু, একই ডিগ্রিধারী স্বামীর কাছে হাতখরচ চেয়ে নিতে হয় নীলাকে। এমনকি প্রতিমাসের খরচের টাকা নিয়ে রাতুল ও নীলার মধ্যে বেশ ঝগড়াঝাটিও হয়। সংসার খরচের সকল হিসাবে সামান্য ভুলচুকে রাতুল নীলাকে কথা শোনায়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চডিগ্রি নিয়েও নীলার অর্থনৈতিক মুক্তি মিলেনি, মিলেনি সম্মান।
পরিশেষে দুটি ঘটনার আলোকে দেখা গেলো যে, সমাজের উঁচু থেকে নিচুস্তরে নারীকেই মানিয়ে নিতে হয়। নারী আন্দোলনের শত বছর পেরিয়ে এসে আজও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি মিলে নি। আজও নারীকে নিজের ইচ্ছে, স্বপ্ন ও আশা বলি দিতে হয় সংসার, স্বামী সন্তান ও সমাজের কথা ভেবে। পুরুষের রক্তচক্ষু শাসনে, সংস্কারের বেড়ি পায়ে কতশত নারী নিভৃতে কাঁদে। তবুও আমরা আশাবাদী, হয়তো একদিন নারীকে কেবল নারী না ভেবে মানুষ ভাবা হবে। কারণ আজকের যুগে নারীদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলছে বহু শিক্ষিত সুশীল পুরুষ। হয়তো সেই দিন বেশি দূরে নয় যেদিন নারীর মনের মূল্য দিয়ে নারীর প্রাপ্ত অধিকার টুকু সম্মানের সাথেই তাকে বুঝিয়ে দিতে কেউই কুণ্ঠিত হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবু জাফর শামসুদ্দীন : প্রগতিমনস্ক লেখক ও সাংবাদিক
পরবর্তী নিবন্ধনারী