প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার : যাতায়াত এবং পর্যটনের বিকাশ প্রসঙ্গে

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে কক্সবাজার শহরের অবস্থান। ফলে ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলে ভ্রমণকারীদের জন্য কক্সবাজার অন্যতম আকর্ষণীয় শহর। বৃহত্তর বরিশালের কুয়াকাটা সাগরপাড়ে হলেও কক্সবাজারের সাথে তুলনায় হবেনা।

পাকিস্তান আমলে ভ্রমণকারীরা কক্সবাজার গমন করতেন বেড়ানোর জন্য। যোগাযোগ প্রতিকূলতায় হয়ত ভ্রমণকারীর ব্যাপকতা ছিলনা। তারপরও চট্টগ্রাম শহর থেকে কাঠের বাসে ৬ টাকা ভাড়া দিয়ে কক্সবাজার যাওয়া হত। ৫/৭ টি বা ৮/১০ টি আবাসিক হোটেল ছিল বলা চলে। তখন কক্সবাজার ছিল চট্টগ্রামের আওতাধীন একটি মহকুমা। সেই পাকিস্তান আমলে কক্সবাজার বিমান বন্দর চালু ছিল। চট্টগ্রামকক্সবাজার নিয়মিত ফ্লাইট ছিল। ১৯৬০ এর দশকে ২২ টাকা ভাড়া দিয়ে জীবনে প্রথম চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়া হয়। ৪০ আসনের ঋ২৭ ছোট প্লেইন। প্লেন আকাশে উঠলে সমুচা, স্যান্ডউইচ, কেক সহ চা কফি দিয়ে আতিথেয়তা ছিল বিমানের ভিতর। তখন চট্টগ্রামঢাকা বিমান ভাড়া ছিল ৪০ টাকা।

পাকিস্তান আমল ত নয়ই, বাংলাদেশ আমলের শুরুর দিকেও ভ্রমণকারীদের সেন্টমার্টিন যাওয়াআসার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিলনা। ব্রিটিশ পরবর্তী পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়া আসার প্রধান মাধ্যম ছিল সাগরপথে জাহাজে করে। বাংলাদেশ এর দীর্ঘ ৫০ বছরের ব্যবধানে দেশের প্রধান পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজারকে অবহেলিত বলা যাবে। এই দীর্ঘ ৫০ বছরের ব্যবধানে হোটেলের সংখ্যা অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তৎমধ্যে ৫ তারকামানের হোটেলও রয়েছে কয়েকটি। চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজারের আকাশ যাতায়াত অনেকটা অবহেলিত। কিন্তু ঢাকার সাথে কক্সবাজার আকাশ যাতায়াতে গুরুত্ব লাভ করেছে সচ্ছল ভ্রমণকারীদের কল্যাণে।

কক্সবাজার জেলা উজানটিয়া, রাজাখালীতে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে পৈতৃক জমি জমা রয়েছে। যা কক্সবাজার মহকুমা পরবর্তী কক্সবাজার জেলার আওতাভুক্ত তথা নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে দীর্ঘ ৫০ বছরের ব্যবধানে বছরে এক বা একাধিক বার চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাতায়াত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগত অনুভূতিতে বলতে পারি কক্সবাজার দেশের প্রধান পর্যটন এলাকা হিসেবে চরম অবহেলিত। কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরছি।

() চট্টগ্রামকক্সবাজার মহাসড়কটি চার লাইনে উন্নীত হওয়া অত্যাবশ্যক। যা ১০/১৫ বছর আগে হওয়া উচিত ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার জনসভায় চার লেইনের ঘোষণা দিয়েছেন ৫/৭ বছর হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতায় দৃশ্যমান হচ্ছেনা। দোহাজারীকক্সবাজার রেলের মূলধন দিয়ে চট্টগ্রামকক্সবাজার মহাসড়ক চার লাইন করার পক্ষের শতকরা ৮০ জনের অধিক সচেতন নাগরিক।

() পতেঙ্গায় কর্ণফুলী তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। কাজ শুরু হয়েছে ৩/৪ বছর হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু টানেলের সুফল পেতে আনোয়ারাবাঁশখালীপেকুয়া আঞ্চলিক সড়কটি সম্প্রসারণ উন্নয়ন আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা হল না। কবে হবে তা অনিশ্চিত।

() চকরিয়াবদরখালী থেকে সাগরের পাশ দিয়ে কক্সবাজার মাত্র ৩০/৩৫ কি.মি. সড়কটি আজও বাস্তবায়নের কোন খবর নেই। ফলে প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে শত শত গাড়ি আনোয়ারাবাঁশখালীপেকুয়া হয়ে কক্সবাজার যেতে ৩০/৪০ কি.মি ঘুর পথে চকরিয়া গিয়ে চট্টগ্রাম আরাকান মহাসড়কে যেতে হচ্ছে। কক্সবাজার শহরে হোটেল, সাগরতীর মাত্র, হাজার হাজার ভ্রমণকারীর জন্য আর কোন আয়োজন নেই।

() কক্সবাজারে সারা দেশ থেকে সারা বছর কম বেশি ভ্রমণকারীদের যাতায়াত থাকে। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বস্ত থাকা যাচ্ছেনা। নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলা চলে।

সেন্টমার্টিন মাত্র ৮ বর্গ কিলোমিটারের ছোট দ্বীপ। ৫/৭ হাজার জনগণকে টেকনাফের পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে দেয়া মনে হয় খুব সাধারণ ব্যাপার। নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে পর্যটন কর্পোরেশনের সহযোগিতায় সীমিত সংখ্যক পর্যটকের নেয়াআনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে দেশের নিরাপত্তার জন্য কল্যাণকর একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি রক্ষা পাবে। হোটেল আর হোটেল বাদে মনে হয়না কঙবাজারের কল্যাণে তেমন কিছু করা হয়েছে বা হচ্ছে।

মীরসরাই থেকে সাগরপাড় দিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ করার কথামাঝে মধ্যে সংবাদপত্রে দেখা যায় টেলিভিশনে শোনা যায়। বাস্তবতার খবর নেই।

বাঁশখালীর দক্ষিণাঞ্চলে ৩টি ইউনিয়ন ছনুয়া, পুঁইছড়ি, গন্ডামারা এই তিনটি ইউনিয়ন বাদ দিলে দেশের লবণ শিল্পে একমাত্র কক্সবাজার জেলা। সাথে আছে সামুদ্রিক মাছ, মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানির সুবাদে ব্যাপক ধানের ফলন। পাহাড়ের নানান বনজ ফলদ গাছ এই সব কিছু মিলে কক্সবাজার জেলা দেশের কল্যাণে অতুলনীয় অবদান রেখে আসছে। সেই তুলনায় এই জেলা অবহেলিত বলা যাবে।

কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিকে উন্নিত করতে কাজ চলমান। এই কাজ শেষ হয়ে সুফল আনবে তা মনে হয় সুদূর পরাহত।

অতএব, কক্সবাজারের উন্নয়নে পর্যটনের বিকাশে উপরিউক্ত সুপারিশগুলোর আলোকে সরকার যাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।

করোনা মহামারীসহ নানান কারণে ৪/৫ বছর কক্সবাজার যাওয়া হয়নি। রেল সংযোগের কাজ বাদে এই ৪/৫ বছরে কক্সবাজার পর্যটন শহর হিসেবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোন অবদান দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলনা। ১৯ মে শুক্রবার ভোরে চট্টগ্রাম থেকে আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম, এমদাদ উল্লাহকে নিয়ে সকাল ১০ টার মধ্যে কক্সবাজার শহরে পৌঁছি।

কোর্টহিলস্থ খতিব আলহাজ্ব মাহমুদুল হকের সাথে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক বিধায় এ মসজিদে জুমা পড়তে যাই। দেখলাম কেন্দ্রীয় মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। মসজিদের পুকুরটি ভরাট করা হয়েছে। এই মসজিদ পুনঃনির্মাণ কখন শুরু হবে, এবং কতদিনে শেষ হবে অজানা।

দুঃখের বিষয় ৩/৪ বছর আগে পুকুরও ভরাট করা হয়েছিলো মসজিদ পুনঃনির্মাণের লক্ষ্যে। পাশ্ববর্তী একটি অস্থায়ী ছোট টিন শেড মসজিদে নামাজ চলমান। জানতে পারলাম দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে ঠিকাদার কাজ শুরু করছেনা। তাই বলে এ রকম কেন্দ্রীয় মসজিদের কাজ অবহেলিতভাবে পড়ে থাকতে পারেনা।

কক্সবাজার শহরে শুধু হোটেলের সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ বাদে পর্যটন কল্যাণে তেমন কোন উন্নয়নমূলক কাজ দৃষ্টিগোচর হলনা। সরকারের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নের কোন খবর নেই। বিশ্বের বুকে সাগরতীরে বহু নামকরা পর্যটন শহর রয়েছে। তৎমধ্যে মুসলিম বিশ্বেও কম নয়। শালীনতা রক্ষা করে কক্সবাজার পর্যটন শহরকে সাজানো কোন ব্যাপার নয়। বিভিন্ন মাছের বিশাল এ্যাকুরিয়াম, বিশাল আকৃতির শিশু পার্ক, কক্সবাজারসেন্টমার্টিন হেলিকপ্টার সার্ভিস রাখা যেত। যা কিছু হবে আন্তর্জাতিক মানের হওয়া চাই।

কিছুদিন আগে কক্সবাজার শহরে ছিলাম ২ রাত। যেহেতু ২০ মে শনিবার কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসা মিলনায়তনে হজ্বযাত্রীর কল্যাণে আমার প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রোগ্রাম ছিল। চট্টগ্রাম থেকে যুগ্ম মহাসচিব সালেহ আহমদ সুলায়মান অংশগ্রহণ করেন। শহরের ভিতর প্রধান সড়কটি সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আজও সমাপ্ত হয়নি। এখানে ২/৩ টি ফুটওভার ব্রীজের নির্মাণ কাজ চলমান। আমাদের দেশে অধিকাংশ ফুটওভার ব্রীজ পরিত্যক্ত বলা যাবে। কক্সবাজার শহরের ব্যাপারে ফুটওভার ব্রীজ সময়ই বলে দিবে।

অতএব দেশের প্রধান পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে গুরুত্ব দেয়া হোক। সাথে সাথে উল্লিখিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সরকার যাতে এগিয়ে আসে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র চিন্তা