(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ভারতবর্ষের নবাব, ধনীরা মসজিদ পুনঃ নির্মাণ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায়ও অর্থ ব্যয় করেন। বিশেষ করে মক্কা মোকাররমায় মাদ্রাসায়ে সাওলাতুননিসা বেগম নাম নিয়ে জনৈকা ধনী ও দ্বীনদার মহিলা কর্তৃক এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত। তিনি এক বুজুর্গ ব্যক্তির পরামর্শে এ কাজ করেন। এতে আরব উপদ্বীপ ছাড়াও আফ্রিকার একাধিক নিকট আরব অঞ্চল, পারস্য অঞ্চলের ছাত্ররা শিক্ষা নিত। এখানকার গ্রন্থাগারও ছিল সমৃদ্ধ। ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত এ মাদ্রাসা চালু ছিল।
পবিত্র আরব ভূমির সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য বিভিন্ন স্থানে গমন করতেন। তৎমধ্যে কায়রো, দামেস্ক, বাগদাদ, কুফা, বসারার পাশাপাশি ভারতবর্ষ অন্যতম। অসংখ্য আরবীয় সন্তান ভারতে লেখাপড়ার জন্য সেই সময় দিল্লি, হায়দ্রারাবাদ, লক্ষ্ণৌ, রামপুর, বাংলার সোনারগাঁ, গৌড়, পান্ডুয়াতে আসতেন অধিকতর শিক্ষা লাভের জন্য। যেহেতু বর্তমান সৌদি আরবের প্রথম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পবিত্র মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।
চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ একাধিক আওলাদে রাসূলকে খতিব হিসেবে পেয়ে গর্বিত। তৎমধ্যে হযরত সৈয়দ আবদুল হামিদ বোগদাদী, হযরত সৈয়দ আবদুল কাদের ছাদেক, হযরত সৈয়দ সাক্কাফ, হযরত সৈয়দ আবদুল করিম আল মাদানী, হযরত সৈয়দ আবদুল আহাদ আল মাদানী, হযরত সৈয়দ আনোয়ার হোসাইন তাহের জাবেরী আল মাদানী অন্যতম।
হযরত সৈয়দ আবদুল করিম আল মাদানী ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে মদিনা মুনাওয়ারায় জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদে খতিবের দায়িত্বে আসেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জানুয়ারি তথা ১৫ শাওয়াল চট্টগ্রামে ইন্তেকাল করেন। পাকিস্তান ও সৌদি উভয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক সালাহ উদ্দিনের প্রচেষ্টায় তার দেহ মোবারক পবিত্র মদিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। মসজিদে নববীতে ২য় জানাজার পর জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। লালদীঘির মাঠে তাঁর প্রথম জানাজা হয় সেই সময় লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে।
হযরত সৈয়দ আবদুল কাদের ছাদেক চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় মসজিদ সংলগ্ন শায়িত। হযরত সৈয়দ সাক্কাফ শেষ বয়সে আরব ভূমিতে ফিরে যান। হযরত সৈয়দ আবদুল আহাদ আল মাদানী ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চতর জ্ঞানার্জনের লক্ষে ভারতবর্ষে আগমন করেন। ত্রিপুরা বিখ্যাত জমিদার গেদু মিয়ার বোনকে শাদী করেন। খতিব মহান আওলাদে রাসূলগণ ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। ধর্ম পাশ কাটিয়ে কারও সাথে আপোষ করতে চাইতেন না। হযরত সৈয়দ আবদুল আহাদ আল মাদানী (রহ.)’র সাথে চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে সেই সময়কার রাষ্ট্রপতি কোলাকোলি করতে চাচ্ছিল। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন আপনার গলায় স্বর্ণের চেইন, আমি আপনার সাথে কোলাকোলি করতে পারব না। সৈয়দ আবদুল করিম মাদানী ইন্তেকালের পর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ রমজান চট্টগ্রাম শহরে ইন্তেকাল করেন ও স্টেশন রোডের চৈতন্যগলি সাধারণ কবরস্থানে শায়িত হন। তাঁর একমাত্র পুত্রের ঘরে এক নাতি ফয়সল ও এক নাতনি ফাতেমা।
আরব উপদ্বীপ তথা জজিরাতুল আরব। ধু-ধু বালি তথা বালুকাময় অঞ্চল। লাখ বা লাখের কম বেশি লোক হজ্ব করত। নিরাপত্তা, যোগাযোগ প্রতিকূলতায় হজ্ব করা অনেক দুরূহ ছিল। যেখানে হজ্ব করা কঠিন সেখানে ওমরাহ কথা তেমন আসছে না। যদিওবা কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফ মতে ওমরাহও স্বীকৃত। হজ্বের পর সেখানকার আধিবাসীগণ বেকার হয়ে পড়তেন। তারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্থিক সহায়তা পেতে গমন করতেন, তৎমধ্যে ভারতবর্ষের চট্টগ্রাম অন্যতম। সাগরপথে উপমহাদেশের সাথে আরবের যাতায়াতের কথা আগে উল্লেখ করা আছে। ১৯ ‘শ’ শতকে এসে এ যাতায়াত আরও উন্নত হয়ে যায়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উপমহাদেশ বিভাগের পর করাচি-চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়মিত জাহাজ যাতায়াত ছিল। সময় লাগত ৭ দিন, ডেক শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৯৩/৯৫ টাকা। এ সময় দুই পবিত্র নগরী থেকে আরবীয়গণ করাচি হয়ে চট্টগ্রাম আসতেন। চট্টগ্রাম শহরে একাধিক উদারপ্রাণ ব্যক্তিগণ আতিথেয়তা করাতেন, সাথে করতেন সাহায্য সহযোগিতা। আরবীয়গণ বাঁশখালী, বৃহত্তর চকরিয়ার জমিদারগণের বাড়িতে যেতেন। জমিদারগণের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ খোলা মনে সাহায্য করতেন। বিশেষ করে বয়স্ক মহিলাগণের স্বর্ণ দিয়ে দেয়া উল্লেখ করার মত। এমনিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ উদার মনের বলে স্বীকৃত। মানুষের স্বভাব দুইভাগে; একভাগ পেয়ে খুশি, আরেকভাগ দিয়ে বা করে খুশি। চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষ দিয়ে বা করে খুশি। হয়তবা এখন সেই ত্যাগ, উদারতা আগের মত নাও থাকতে পারে। আরবীয়গণের চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমন ১৯৫০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত ছিল।
সেই সময় হজ্ব উপলক্ষে গমন করে দীর্ঘ সময় থাকা হত। অনেকে হজ্ব করে মদিনা মুনাওয়ারা চলে যেতেন। তথায় দীর্ঘ সময় থাকতেন। আবার পুনঃ হজ্ব করে দেশে ফিরতেন। অনেকে হজ্বের আগে পরে জেরুজালেম, বাগদাদ, কুফা, কারবালা, বসরায়ও যেতেন। তখন হেজাজসহ ঐ সমস্ত বিশাল অঞ্চল তুর্কি সুলতানগণের এক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত ছিল।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে হজ্বের ক্ষেত্রে অনেকের অবদান রয়েছে। তিন ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করে নিতে হবে। (১) আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী (২) চাঁন মিয়া সওদাগর (৩) মুহাম্মদ ইসলাম খান।
বদি আহমদ চৌধুরী ১৯১৯ সালে যৌবনকালে নিজের ফরজ হজ্ব আদায় করেন তুর্কি আমলে। তিনি ভারতীয় হজ্ব কমিটির একাধিক বার মেম্বার ছিলেন। ১৯৩৫ সালে বোম্বাই হয়ে আমিরুল হজ্ব হিসেবে ২য় বার হজ্বে গমন করেন। আর্থিকসহ নানান অব্যবস্থাপনায় পবিত্র মক্কায় হজ্বযাত্রীরা কষ্ট পাচ্ছিলেন। বাদশাহ আবদুল আজিজ পবিত্র মক্কায় থাকায় তিনি হজ্বযাত্রী, বিশেষ করে ভারতীয় হজ্বযাত্রীর কল্যাণে একাধিক বার বাদশাহ আবদুল আজিজের সাথে সাক্ষাত করেন। ভারতবর্ষের হজ্বযাত্রীগণের হজ্বে গমনের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল মুম্বাই হয়ে সাগর পথে। বদি আহমদ চৌধুরীর বারে বারে প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার রাজি হওয়ায় চট্টগ্রামের প্রখ্যাত শিপিং লাইন ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরীর জাহাজে করে ১৯৩৭ সালে কলকাতা বন্দর হয়েও হজ্বযাত্রী গমনাগমন শুরু হয়।
চাঁন মিয়া সওদাগর দুই পবিত্র নগরীতে মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন হজ্বযাত্রীর কল্যাণে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে সৌদি মোয়াল্লেমগণ আসলে তাদের দেখভালের ব্যবস্থা করতেন।
মুহাম্মদ ইসলাম খানও দুই পবিত্র নগরীতে হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রাম মহানগরীতে সৌদি মোয়াল্লেমগণ আসলে তিনি দেখবাল করতেন। স্টেশনস্থ তার মিসকা হোটেলে মোয়াল্লেমগণ অবস্থান নিতেন। তিনি হজ্ব কমিটির মেম্বার ছিলেন।
ব্রিটিশ আমলে হজ্ব করার পর অনেকে তার বর্ণনা, অভিজ্ঞতা লিখে গেছেন। বিশেষ করে চুনতীর মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.) ফার্সি ভাষায় হজ্ব নামা লিখেন, যা ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মগনামা জমিদার ওয়াইজ উদ্দিন মোহরী ৫ জন সহযাত্রীসহ এবং উত্তর হাটহাজারী মাওলানা এয়ার মুহাম্মদ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে হজ্ব করে তার বর্ণনা লিখে যান। তারা হজ্বের পাশাপাশি জেরুজালেম, বাগদাদ, কুফা, কারবালাও গমন করেন।
বস্তুতঃ বিশ্বের বুকে অত্যধিক মুসলমান প্রবণ অঞ্চল ভারতবর্ষ। অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ার পর, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান মিলে বর্তমানে প্রায় ৬০ কোটির মত মুসলমান। আজও ভারতবর্ষের সাথে দুই পবিত্র নগরীর তত্ত্বাবধায়ক সৌদি আরবের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তথ্য সূত্র: সীরত বিশ্বকোষ, ইসলামী বিশ্বকোষ, ঞযব জড়ধফ ঞড় গবপপধ, আরব জাতির ইতিহাস, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইন্টারনেট, বিবিধ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট