প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী ও তাঁর খলিফা আদম বিন নূরী (রহ.)

ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)। অর্থাৎ হাজার বছরের মুজাদ্দেদ। বিশ্বের বুকে শত বছরের মুজাদ্দেদ তথা সংস্কারকগণ অনেকে রয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (স.)’র ওফাতের এক বছরের ব্যবধানে হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী শেখ আহমদ ফারুকী (রহ.)ই বিশ্বে হাজার বছরের একমাত্র মুজাদ্দেদ হিসেবে স্বীকৃত। বাদশাহ আকবরের দ্বীনি এলাহী প্রতিরোধ, তাঁর ইন্তেকালে বাদশাহ জাহাঙ্গীরও প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ায় গুয়ালিয়রদুর্গে বন্দী করে রাখেন মুজাদ্দেদে আলফেসানীকে। এতে দেশব্যাপী আন্দোলনে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের তক্ত নড়চড়ে উঠা, হযরত মুজাদ্দেদকে সসম্মানে মুক্তি দেয়, ক্ষমা প্রার্থী হন। দ্বীনি এলাহী থেকে সঠিক ইসলামে ফিরে আসেন।
তিনি এক দিকে হাজার বছরের মুজাদ্দেদ হিসেবে ভারতবর্ষে ইসলামের সুরক্ষায় ত্যাগ স্বীকার করে ভূমিকা পালনকারী। অপরদিকে মুজাদ্দেদীয়া তরীকার ইমাম।
তাঁর মহান খলিফা হযরত আদম বিন নূরী (রহ.)। আদম বিন নূরী (রহ.) নিজের পীরের প্রসিদ্ধ খলিফাগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। প্রায় সময় নিজের পীরের সান্নিধ্যে থাকতেন। স্বল্প সময়ে অধিক সুফল প্রাপ্তগণের মধ্যে ছিলেন। তাঁর হাল ও মকামসমূহ ছিল উচ্চ মর্যাদার। দক্ষতা ও আত্মশুদ্ধি সবকিছু নিজের পীরের বিশেষ তাওয়াজ্জুহ-তে অর্জন করেছিলেন। তিনি সুন্নতের অনুসরণ এবং শিরক বেদআত উচ্ছেদের ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন। শরীয়ত ও তরিকতের পূর্ণ দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দানশীলতা, উদারতা তাঁর মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। ধনী-গরীব, আমির-খাদেম, মাখদুম-সন্তান-দরবেশ সকলেই তাঁর দৃষ্টিতে সমান কারও মধ্যে তিনি পার্থক্য করতেন না। শুধু তাই নয়, একজন নেককার দরবেশ পরিপূর্ণ পবিত্রতার সাথে তার দরবারে খাদ্য রান্না করতেন। হযরত আদম বিন নূরী তা সকলের সাঝে সমানভাবে বন্টন করে দিতেন।
হযরত আদম বিন নূরীর ছিল দৈনন্দিন বিশাল মাহফিল। এতে অহংকার, লোক দেখানো কোন কিছুই ছিল না। শুধু তাই নয়, গরীবের উপর ধনীর কোন পার্থক্য ছিল না। আল্লাহর দরবেশের এ মহান ওলি সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এ মহান শেখ কখনও কখনও দুনিয়াদার লোকদের প্রতি এমন কঠোর হতেন যে, যা অন্য কেউ এত কঠোর হতে পারত না। তাঁর কথায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করত। প্রতিদিন অসংখ্য লোক তাঁর কাছে এসে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসত।
হযরত আদম বিন নূরী (রহ.)’র প্রায় একশত খলিফা রয়েছে। সেকালে মুরিদের সংখ্যাও লক্ষাধিক। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এত বেশি ছিল যে, দূর দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে লোকেরা তাঁর দরবারে আসত। সাক্ষাত লাভের পর তওবা করে শরীয়তের সঠিক নির্দেশনায় চলত। শুধু তাই নয়, তাঁর সাথে নিয়মিত অসংখ্য ফকির দরবেশের জমায়েত থাকত। তিনি পিতার দিক দিয়ে সৈয়দ বংশীয় ছিলেন। তাঁর দাদী ছিলেন আফগান বংশদ্ভেূাত। তাঁর জন্মভূমি রাদায় তথা অন্যত্র হলেও নিজের পীরের সান্নিধ্য পেতে সেরহিন্দের বিন্‌ নূর নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন।
সাধারণ জনগণের মাঝে তাঁর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা বেড়ে যাওয়ায় সম্রাট শাহজাহানের পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব হয় নাই। হযরত আদম বিন নূরী একবার লাহোর গমন করেন। সে সময় আফগানিস্তানসহ অন্যান্য এলাকার লোকজনের বিশাল বিশাল কাফেলা তাঁর সান্নিধ্য পেতে আসেন। একজন ধর্মীয় দরবেশের সাধারণ জনগণের মাঝে ভক্তি শ্রদ্ধার বিশালতা সম্রাট শাহজাহানের পছন্দ হল না।
এক বর্ণনায় সম্রাট এ মহান শেখকে ভারতবর্ষ থেকে পবিত্র আরব ভূমির দিকে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা ১০৫৩ হিজরির ঘটনা। এমনিতে হযরত আদম বিন নূরী (রহ.) হজ্বব্রত পালন ও মদিনা মুনাওয়ারা যেতে উদগ্রীব ছিলেন। অন্যদিকে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে তিনি মক্কা মোকাররমায় হিযরত করেন। হজ্বব্রত পালন শেষে মদিনা মুনাওয়ারায় উপস্থিত হন; ৪০ দিন পর্যন্ত তথায় ছিলেন। অতঃপর তিনি পবিত্র মদিনায় ইন্তেকাল করেন। আমিরুল মোমেনীন হযরত ওসমান (র.)’র কবরের কিছুটা দূরত্বে তাকে সমাহিত করা হয়।
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)’র মতান্তরে ২২ জন মহান খলিফার তালিকা পাওয়া যায়। তাঁর অতিরিক্ত ইমামে রব্বানী (রহ.)’র মহান সাহেবজাদাগণ রয়েছেন। বিশেষ করে হযরত খাজা মুহাম্মদ মাসুম (রহ.)’র মাধ্যমেও মুজাদ্দেদীয়া সিলসিলা প্রসারিত।
তেমনিভাবে হযরত আদম বিন নূরী (রহ.)’র মাধ্যমে মুজাদ্দেদীয়া সিলসিলা আরাকান থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। হযরত আদম বিন নূরী (রহ.)’র প্রায় ১ শত জন খলিফার মধ্যে অন্যতম হল হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ আকবরাবাদী (রহ.)। আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে কবরস্থানে শায়িত। তাঁর খলিফা হযরত আবদুর রহিম মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.)। দিল্লি মেহেদীয়ান এলাকায় জামেয়া রহিমিয়া কম্পাউন্ডের ভিতর শায়িত। তাঁর খলিফা ও পুত্র হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.)। তাঁর খলিফা ও পুত্র হযরত শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.)। উক্ত মহান তিন শেখ একই কবরস্থানে পর পর শায়িত। তাঁর খলিফা হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)। পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরে শায়িত। আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্‌ফরাবাদের নিকটে বালাকোটে ১২৪৬ হিজরির যিলকদ মাসে ধর্ম যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর খলিফা হযরত সুফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী চাঁটগামী (রহ.)। তিনি বালাকোটে ধর্ম যুদ্ধে নিজের পীরের সাথে ছিলেন। মীরসরাই উপজেলা সদর থেকে ৪ কি.মি পশ্চিমে মালিআইশে শায়িত। তাঁর খলিফা রসূলনোমা হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)। কলকাতা মহানগরীর মানিকতলা মুন্সিপাড়া লেইন কবরস্থানে শায়িত।
তাঁর ৩৫ জন খলিফা রয়েছে। তৎমধ্যে হযরত সুফি গোলাম সালমানী ফুরফুরা (রহ.), হযরত আবু বকর সিদ্দিকী ফুরফুরা (রহ.)। উভয়ে ফুরফুরায় ১ কি.মি ব্যবধানে শায়িত। হযরত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (রহ.) কলকাতা পাক সার্কাস গোবরা ১ কবরস্থানের উত্তরপাশে শায়িত। হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র ৩৫ খলিফার মধ্যে বৃহত্তর বাংলাসহ ভারতবর্ষে বিশালত্ব রয়েছে। এর মধ্যে এ তিনজন খলিফার সিলসিলা অন্যতম।
তৎমধ্যে হযরত সুফি গোলাম সালমানী ফুরফুরা (রহ.)’র অন্যতম খলিফা হলেন- হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল-হাসানী ওয়াল-হোসাইনী। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বান্ডেল রেল স্টেশন সংলগ্ন শায়িত। তাঁর খলিফা হযরত মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী আজমগড়ী (রহ.)। ভারতের উত্তর প্রদেশের বিভাগীয় শহর গোন্ডায় শায়িত। তাঁর রয়েছে ৪৪ জন খলিফা। তৎমধ্যে ১৬ জন খলিফার চট্টগ্রামে খেদমত রয়েছে। বিশেষ করে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর (রহ.) ও হযরত ছোট হুজুর (রহ.), হযরত আবদুস সালাম আরাকানী (রহ.), হালিশহর হযরত সৈয়দ মুনীর উদ্দিন (রহ.), হযরত মাওলানা ফজলুল হক (রহ.) ও হযরত মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) অন্যতম।
সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী এবং সাথে আজমগড়ী সিলসিলা বিষয় নিয়ে আমার রচিত “ওয়াইসী হয়ে আজমগড়ী সিলসিলা”গ্রন্থে বিস্তারিত রয়েছে।
হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) ভারতের পাঞ্জাবে শায়িত। এ পাঞ্জাব শিখ অধ্যুষিত; মুসলমানদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। পাঞ্জাবের সেরহিন্দে প্রায় ১৫/২০ একর এরিয়া নিয়ে বিশাল মাজার কমপ্লেঙ। সাথে তাঁর পরিবারবর্গ, মাজার সংলগ্ন মসজিদ; পূর্ব ও উত্তর দিকে কবরস্থান। এখানে তাঁর প্রখ্যাত সন্তান হযরত মুহাম্মদ মাসুম (রহ.)সহ অনেকে শায়িত। এ এরিয়ার পশ্চিম দক্ষিণ দিকে তুর্কি সুফিগণের অর্থানুকূলে ৪/৫ বছর আগে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তিনতলা বিশিষ্ট প্রকান্ড গেস্ট হাউস নির্মাণ করে দেয়া হয় যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে। হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)’র পীর হচ্ছেন হযরত খাজা বাহাউদ্দিন (রহ.)। নতুন দিল্লি রেল স্টেশনের মাত্র ১ কি.মি উত্তরে নবী করিম এলাকায় চৌরাস্তার পশ্চিম সংলগ্ন প্রকান্ড কবরস্থানে শায়িত, সাথে মসজিদ।
নক্‌শবন্দিয়া সিলসিলা থেকে মুজাদ্দেদীয়া সিলসিলা। উজবেকিস্তানকে নক্‌শবন্দিয়া সিলসিলার জমি বলা হয়। হযরত খাজা নক্‌শবন্দ বাহাউদ্দিন (রহ.)সহ তাঁর আগে পরে অনেকে বৃহত্তর বোখারা বৃহত্তর সমরকন্দে শায়িত। তুর্কিদের মধ্যে অধিকাংশ এ সিলসিলার।
২৮ সফর হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানীর ওফাত বার্ষিকী। এ উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে মাহফিলের আয়োজন করা হয়। হয়ত করোনা মহামারী বিধায় এই বছর সীমিত পরিসরে হলেও হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধব্যর্থতার জন্য অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্ষমা চাইলেন কিম