পবিত্র মদিনায় রওজা পাক যেয়ারতে সৌদির নমনীয়তা
মহান রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসে নবী পাক (স.)’র রওজাপাকে যেয়ারতের গুরুত্ব নিয়ে আজকের এ লিখা। আমরা যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতে বিশ্বাসী তারা মদিনা মুনাওয়ারায় গমন করে থাকি আল্লাহর রাসূল (স.)’র রওজাপাকে সালাম পেশ করার নিয়তে। জানি না এতে হাজারে ২/১ জনের ভিন্ন মত আছে কিনা।
তবে আহলে হাদীস তথা সালাফীদের মধ্যে অধিকাংশ মনে হয় যেয়ারতের উদ্দেশ্যে নয় পবিত্র মদিনায় মসজিদে নববীতে নামাজের নিয়তে যেতে ইচ্ছুক। সেই সুযোগে রওজপাকে যেয়ারত করা যাবে।
১৯৭০/৮০ এর দশকে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় অবস্থানকালে তাদের মতাদর্শের কথা বারে বারে জানতে পারি, বুঝতে পারি। মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববীতে এবং বিভিন্ন বিজ্ঞজনের কাছে সেই সময় প্রকাশ্যে আলোচনার বিষয় ছিল হজ্ব ও ওমরাহকারীগণ পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারা গমন করলে নিয়ত নিয়ে অর্থাৎ নিয়ত থাকতে হবে পবিত্র মদিনায় গমন করবে মসজিদে নববীতে নামাজের নিয়তে। রওজাপাকে সালাম পেশ করার নিয়তে নয়। তবে মসজিদে নববীতে নামাজের নিয়তে পবিত্র মদিনায় উপস্থিত হলে তখন রওজাপাকে সালাম পেশ করা যাবে। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের পর থেকে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে নমনীয়তা এসে যাচ্ছে। মদিনা মুনাওয়ারা কি নিয়তে গমন করবে, মনে হয় এ নিয়ে তেমন আলোচনা পর্যালোচনা করতে চাচ্ছে না।
হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় কাবা শরীফে নামাজ পড়লে ১ লক্ষ রাকাতের সওয়াব, মসজিদে নববীতে নামাজে আমাদের মতে ৫০ হাজার, আহলে হাদীস বা সালাফীগণের মতে ১ হাজার রাকাত এর সওয়াব।
পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনার দূরত্ব ৪২৫ কি.মি। তথা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব। হজ্ব ওমরাহকারী যখন পবিত্র মক্কায় যাবে তখন ১ লক্ষ নামাজের সওয়াব ছেড়ে ১ হাজার বা ৫০ হাজার সওয়াব পাওয়ার আশায় কেন পবিত্র মদিনায় যাবে তা স্বভাবতই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু ১৯৭০/৮০ দশকে বারে বারে শুনে আসার পরেও বিশ্বের মুসলমানদের কাছে মনে হয় এর কোন প্রভাব পড়ছে না । উম্মতে মুহাম্মদী হজ্ব বা ওমরাহর উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কার পাশাপাশি পবিত্র মদিনায় যেতে মন থেকে তাড়িত হয় তার মূলে প্রিয় নবী পাক (স.)’র রওজাপাকে সালাম পেশ করা। এতে সওয়াব কি হচ্ছে না হচ্ছে তা মুখ্য নয়। সেই সুযোগে আল্লাহর হাবীবের মসজিদে নামাজ পড়া হবে।
মনে হয় সৌদি কর্তৃপক্ষ বিশ্বের মুসলমানগণের আবেগ অনুধাবন করতে পারছে। ফলে লাখ লাখ উম্মতে মুহাম্মদী পবিত্র মদিনায় গমন করলে যাতে সুযোগ সুবিধা পান আরাম পান, সেদিকে মনোনিবেশ শুরু হয়ে যায় এবং তা প্রথম শুরু করেন বাদশাহ ফাহাদ। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে মসজিদে নববীকে আগের চেয়ে ৮/১০ গুণ বড় করে বিশালভাবে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে দেন। করে যান দৃষ্টিনন্দন আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর মাধ্যমে। এতে ৪০/৫০ হাজার যেয়ারতকারীর স্থলে ৬/৭ লাখ যেয়ারতকারী পবিত্র মদিনায় অবস্থান করে আরামে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন, যেয়ারতের পাশাপাশি। আগে মহিলাগণ পৃথকভাবে নামাজ পড়লেও পৃথকভাবে যেয়ারতের ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৯০ এর দশক থেকে মহিলাগণের জন্য দিনে রাতে ৩/৪ বার করে পর্দা রক্ষা করে যেয়ারতের ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে। সে লক্ষে রয়েছে পার্টিশনসহ পৃথক ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ ১৯৯০ এর আগে মহিলাগণের পৃথক যেয়ারতের ব্যবস্থা ছিল না।
লাখ লাখ যেয়ারতকারী যাতে আরামে অবস্থান করতে পারে তার জন্য পবিত্র মদিনায় ঘর-বাড়ী, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অফিস-আদালত ভেঙ্গে নতুনভাবে সাজিয়ে দেন বাদশাহ ফাহাদ। পরবর্তীতে বাদশাহ আবদুল্লাহ পবিত্র মদিনায় জেদ্দা ও পবিত্র মক্কা থেকে যাওয়ার জন্য বুলেট ট্রেনের ব্যবস্থা করে দেন। যাতে মাত্র ২ ঘণ্টার ব্যবধানে যেয়ারতকারীগণ অতি আরামে পবিত্র মদিনায় যাওয়া-আসা করতে পারে। বাদশাহ আবদুল্লাহ পবিত্র মদিনার বিমান বন্দরকে সম্প্রসারণ করেন। টার্মিনাল ভবন আধুনিকায়ন করেন। টার্মিনাল ভবনের নিকটে হজ্ব টার্মিনাল নির্মাণ করেন খেজুর গাছের আকৃতিতে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলী দিয়ে। যেহেতু পবিত্র মদিনা খেজুর বাগানের জন্যও বিখ্যাত। এখানে আজোয়া, আম্বুরীসহ অনেক প্রকারের দামিদামি খেজুর উৎপন্ন হয়।
১৯৮০/৯০ দশকের পবিত্র মদিনার বিমান বন্দর আর আজকের বিমান বন্দর এক দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। এ বিমান বন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট দ্রুততার সাথে বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পবিত্র মদিনা নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে। তার অতিরিক্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে হজ্ব ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। এই সব কিছুর মূলে উম্মতে মুহাম্মদীর পবিত্র মদিনায় গমন করে রওজাপাকে সালাম পেশ করতে পারা।
জেদ্দা বিমান বন্দরে হজ্ব টার্মিনাল নাম যথাযথ। কিন্তু পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরে এ হজ্ব টার্মিনাল নাম যথাযথ নয়। নাম হতে হবে হওয়া উচিত যেয়ারত টার্মিনাল।
বর্তমান বাদশাহ সালমান সরকার রওজাপাকের পশ্চিম দিকে যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে তথা সুযোগ সুবিধা পেতে বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। এতে থাকবে স্টারমানের হোটেল, বাস টার্মিনাল, রেস্টুরেন্ট, বাগান ইত্যাদি। এ বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যেয়ারতকারীগণের সুযোগ সুবিধা বহুলাংশে বেড়ে যাবে।
আমাদের দেশীয় পবিত্র মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে দেখা হয়। তাদের থেকেও জানতে পারি রাজ পরিবারের সদস্যরাও আহলে হাদীস/সালাফী/ওহাবী মতাদর্শে। কিন্তু তারাও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনায় আসেন।
রওজাপাকের যেয়ারতের গুরুত্ব নিয়ে একাধিক হাদীস শরীফ রয়েছে। আমাদের মাজহাবের লাখ লাখ আলেমগণের কাছে সহীহ গ্রহণযোগ্য হলেও আহলে হাদীস/ওহাবী মতাদর্শীরা এসব হাদীস শরীফ এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কেন জানি প্রশ্ন তুলত। হয়তবা সৌদিরা এখন নমনীয় হয়ে গেছেন মনে হয়।
আল্লাহর রাসূল (স.)’র হাদীস শরীফ হল:-
⋄ “যে আমার কবর যেয়ারত করবে, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হবে।”
⋄ “আমার ওফাতের পর যে হজ্ব করত: আমার কবর যেয়ারতে আসবে, সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।”
⋄ “যে হজ্ব করল কিন্তু আমার যেয়ারত করল না, সে আমার উপর অবিচার করল।”
⋄ “যে আমার যেয়ারত করবে, সে কেয়ামতের দিন আমার পড়শী হয়ে থাকবে।”
⋄ “যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ ধারাবাহিকভাবে (মাঝখানে কোন ওয়াক্ত বাদ না দিয়ে) পড়বে, তাকে আখেরাতে জাহান্নামের আজাব হতে এবং দুনিয়াতে মুনাফেকী নামক ব্যাধি হতে মুক্তি দেয়া হবে।”
বস্তুতঃ বিশ্বে প্রায় ১৯০ কোটি মুসলমান। শতে ৫/৭ জন ভিন্নমত পোষণ করলেও উম্মতে মুহাম্মদী পবিত্র মদিনায় গমন করবে রওজাপাকে সালাম দেয়ার নিয়তে। এ যেন উম্মতের জন্য পরম পাওয়া, জীবনে সৌভাগ্যের বিষয়। সাথে মসজিদে নববীতে নামাজ ত পড়বেই।
আশা করব সৌদি কর্তৃপক্ষ পবিত্র মদিনায় উম্মতে মুহাম্মদীর যেয়ারতে গমন নিয়ে একমত থাকতে সচেষ্ট আরও হবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট