প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৫ জুন, ২০২২ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি মুসলমানের জীবনে হজ্ব একটি পরম কাঙ্ক্ষিত ইবাদত। তাই হজ্ব করার জন্য যে সফর তা এক পুণ্যের সফর, মোবারক সফর। ঘর থেকে বের হয়ে শেষ করে ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত এ সফর এবাদতে গণ্য। ঈমানের পর চার ফরজ। তথা-নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত। যাদের আর্থিক ও শারীরিক সক্ষমতা রয়েছে তাদের সশরীরে গিয়ে হজ্ব করা ফরজ। বিগত শত শত বছর ধরে হজ্ব একটি অতি কষ্টের, ঝুকিপূর্ণ ও অনিশ্চয়তার সফর ছিল।
বিশ্বে বিগত মাত্র ৬০/৭০ বছর ধরে অতি আরামে হজ্ব করা হচ্ছে। মাত্র ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যে আকাশপথে সৌদি আরব পৌঁছা যাচ্ছে এবং হজ্বের পর দেশে ফিরে আসা যাচ্ছে।
দুই পবিত্র নগরীতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকা হচ্ছে, টয়লেটে পর্যাপ্ত পানি, টাইমে টাইমে ৩ বেলা খাবার ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। যা মাত্র ৬০/৭০ বছর আগেও ছিল না। শত বছর বা তার আগে যারা হজ্ব করেছেন তাদের বর্ণনা শুনলে শরীর শিউরে উঠে।
কক্সবাজার মগনামার ওয়ায়েজ উদ্দিন মুহুরী, উত্তর হাটহাজারীর মাওলানা এয়ার মুহাম্মদ, সুফি খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর লিখে রাখা হজ্বের বর্ণনা পড়লে শরীর লোম শিউরে উঠবে। তারা হজ্ব করেছেন মাত্র শত বছর আগে। তার আগের হজ্ব আরও কষ্টসাধ্য ছিল।
একালে এত আরামদায়কভাবে হজ্ব করার পরেও শতকরা ৭০-৮০ জন হজ্বযাত্রী হজ্বের সফরে নামাজ কাজা করতেছেন। যা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইহা আমাদের হজ্বের সফরে অতি আরামপ্রিয়তা ও ফরজ নামাজের প্রতি অবহেলার অন্যতম কারণ।
এক বিবেচনায় দেশে জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মুসলমান। এরমধ্যে প্রায় ৫ কোটি নর-নারী নামাজী। তৎমধ্যে ১ কোটি নর-নারী শেষ রাতে তাহাজ্জুদ কাজা করে না। এই গবেষণা পর্যালোচনা ধারণায় বুঝা যায় বাংলাদেশে নামাজীর সংখ্যা কমছে না বরং দিন দিন বাড়ছে।
কিন্তু আমরা বাড়ী থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে দূরত্বে কোথাও সফরে গেলে তখন আমাদের কাছে নামাজের গুরুত্ব কমে যায়। দেশের অভ্যন্তরে ট্রেনে বাসে দূরযাত্রায় শতকরা কয়জন নামাজ কাজা করে না ভাবতে হবে।
এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ না পড়ার বিনিময়ে ৭০ বছর নফল এবাদত দিয়েও পূরণ হবে না। অতি সচেতন থাকলে দেশে ট্রেনে বাসে নামাজ কাজা না হয় মত যাতায়াত সম্ভব।
হজ্বের সফরে চট্টগ্রাম বা ঢাকা থেকে সৌদি আরব যেতে নামাজের ওয়াক্ত হতেও পারে, না হতেও পারে। যদি আপনার ফ্লাইট সকালবেলা পড়ে অথবা মাগরিবের পর ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা হয় তবে আপনার নামাজ কাজা না হয়ে জেদ্দা বা পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরে পড়তে পারেন। অর্থাৎ দেশ থেকে সৌদি আরব যেতে ঘড়ি মতে ৩ টা ও সূর্য মতে ৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট বেড়ে যাবে। কিন্তু আপনি যদি হজ্বের পর জেদ্দা বা পবিত্র মদিনা থেকে দেশে ফিরেন তবে অবশ্যই ফ্লাইটে নামাজের টাইম অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। যেহেতু দেশে ফিরতে ঘড়িতে ৩ ঘণ্টা ও সূর্য মতে ৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট কমে যাচ্ছে। যদি সৌদি আরব বিমান বন্দর থেকে দিনের ১০-১১ টার দিকে রওনা দেন তবে আপনাকে যোহর, আসর, মাগরিব বিমানে পড়তে হতে পারে। অর্থাৎ সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরতে বিমানে নামাজ পড়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
হজ্বের পর দেশে ফেরার প্রস্তুতি, কেনাকাটা, মোয়াল্লেম বাসের অপেক্ষা, মোয়াল্লেম বাসের নিয়ম শৃংখলা মানতে বিলম্ব হতে হতে বিমান বন্দরে পৌঁছা, বিমান বন্দরে কয়েক ঘণ্টায় আনুষ্ঠানাকিতা শেষ করা, অতঃপর আরোহণ করা। প্রায় ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা সময়ের পর বিমান আকাশে উঠবে। এ সময় বিমান স্বাভাবিক নিয়মে পৌঁছলে খাবার প্রদান করা হবে। খাবার খাওয়ার পর বিমানের সিটে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর ঘুমের মধ্যে কাহিল হয়ে যায়। এমনি অবস্থায় হজ্ব বা ওমরাহর ৪ শতাধিক যাত্রীকে হেঁটে হেঁটে ডেকে দেয়া হয়েছে নামাজের জন্য। মনে হচ্ছিল তারা আমার উপর বিরক্ত। ৪ শতাধিক হজ্বযাত্রীর মধ্যে শতে ৮/১০ জন নামাজ পড়ল কিনা সন্দেহ।
মোয়াল্লেম বাসে পবিত্র মদিনা যেতে অথবা পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কা বা জেদ্দায় আসতে অনেক হজ্বযাত্রী নামাজ কাজা করে। মিনা, আরাফাত, মুজদালেফায় ৫ দিন ব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমেও নামাজ কাজাকারীর সংখ্যা কম নয়। শুধু তাই নয় পবিত্র দুই নগরীতে কক্ষে বসে গল্প-গুজব করতে করতে হারাম শরীফে জামাত চলে যায়। অনেক হাজীর নামাজের ওয়াক্তেরও খবর থাকে না।
সফরে কষ্ট লাঘবে আল্লাহ নামাজকে সংক্ষিপ্ত ও সহজ করে দিয়েছেন, যাকে কসর নামাজ বলে। কসর নামাজে ফরজ নামাজ ৪ রাকাতের স্থলে ২ রাকাত পড়তে হয়, আর সুন্নত না পড়লেও সমস্যা নাই। সেক্ষেত্রে যোহর, আসর ও এশা ৪ রাকাত স্থলে ২ রাকাত। আহলে হাদীসের মতাদর্শে যোহর ও আসর একসাথে পরপর পড়া যায়। একইভাবে মাগরিব ও এশা। অতএব আমরা হানাফী মাজহাব হলেও সফরে আসর কাযা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে যোহরের সাথে সাথে পড়ে নেয়া নিরাপত্তার খাতিরে উত্তম হবে। পরে আসরের সময়ে পুনঃপড়ে দিবেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, হজ্ব ফরজ এবাদতের সফর, পূণ্যের সফর। এ সফরে নামাজ কাজা করা অতীব দুঃখের দুভার্গ্যের বিষয়। ঈমানের পরে নামাজের মর্যাদা। ধর্মীয় বিজ্ঞগণের মতে হজ্বের চেয়ে নামাজের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। অনেক বিজ্ঞজন ৭০ বার হজ্বের চেয়ে এক ওয়াক্ত নামাজের মর্তবা অনেক বেশি বলেছেন।
আপনি এই মোবারক হজ্বের সফরে ঘর থেকে বের হয়ে সফরের পর ঘরে পৌঁছা পর্যন্ত যদি নামাজ কাজা করে থাকেন তখন আপনাকে ভাবিয়ে তোলা স্বাভাবিক যে, আপনি কি পুণ্য বেশি নিয়ে ফিরলেন; নাকি পাপ বেশি নিয়ে ফিরলেন।
এখন হজ্ব ফ্লাইট শুরুর দিকে। আশা করব হজ্বযাত্রী নর-নারী আপনাদের মোবারক হজ্বের সফরে নামাজ কাজা না হতে সচেষ্ট থাকবেন। মহান আল্লাহ পাক সকলের হজ্বকে কবুল করুক। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুরুষতন্ত্র ও রবীন্দ্রনাথ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে