দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৫ জুন, ২০২২ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

পূর্ব প্রকাশিতের পর
পরবাসী মন আমার। কেমন যেন হু হু করছিল। কী যেন এক শূন্যতায় অন্যরকমের এক হাহাকার বাজছিল ভিতরে। বেজায় খাওয়া দাওয়ার পর শরীর মনে স্বাভাবিক আলস্য আসে, কিন্তু আজ শরীরটা কেমন যেন অচিন হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল টানটান। বিছানার চেয়ে রহস্যভেদের চিন্তা বেশি ঘুরপাক খাচ্ছিল মগজে, মনে। কোন কিছুতেই হিসেব না মিলাতে না পারলেও চিন্তার ঘুড়ি আকাশ থেকে আকাশে চক্কর মারছিল। চমৎকারভাবে বানানো ধুমায়িত কফির মগে চুমুক দিচ্ছিলাম, আয়েশি চুমুক। তবে কেমন যেন স্বস্তি মিলছিল না। কফির প্রতি আমার দুর্বলতা প্রচণ্ড, বহুদিনের। ঠিকঠাকভাবে কফি পেলে অন্য অনেক কিছুরই আর প্রয়োজন হয়না আমার। ধুমায়িত কফি মগে চুমুকে চুমুকে আমার চারপাশ আমিই মাতিয়ে তুলি, নিজেকে নিজেই রঙ্গিন করি। কিন্তু আজ আমার মন পড়েছিল গুহায়। একটু আগে দেখে আসা গুহাগুলোর নানা দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছিল, এক একটি গুহার এক একটি দৃশ্যপট কোনভাবেই মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। একটি দুইটি গুহা নয়, অনেকগুলো গুহা। এত গুহা কোত্থেকে এলো, কেন এলো?
ভাগ্যিস আজ গুহা দেখতে এসেছিলাম। নাহলে পৃথিবীর অনেক বড় একটি বিষয় অজানা থেকে যেতো। পৃথিবীর সপ্তাচার্যের প্রায় সবগুলোই আমি দেখেছি। সবগুলো স্থাপনাতেই আমার কমন প্রশ্ন ছিল, কী করে সম্ভব! সবগুলোতেই আমি বিস্মিত হয়েছি, আশ্চর্য হয়েছি। সুইজারল্যান্ডের সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনের তালিকায় চীনের গুহা না থাকলেও এগুলো যে কত বড় বিস্ময় তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। নিজের ভাগ্যকে এই বলে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম যে, আজকের চমৎকার দিনটিতে অনেক সুন্দর এবং বিস্ময় ঘেরা গুহাগুলো দেখতে পেলাম। সকালে আসতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না আসলে ভুল হতো। এমন এক বিস্ময় না দেখলে পরবর্তীতে কারো কাছে শুনলে মন খারাপ হতো! সকালের ঘুম মাটি করে এতদূর আসা যে সার্থক হয়েছে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় থাকলো না। কিন্তু মন ভরে যাওয়া তৃপ্তিতেও প্রশ্নের ঘুরপাক থেকে বের হতে পারছিলাম না আমি। কেমন করে সম্ভব! কেমন করে!! কারা বানিয়েছেন এই গুহা, কারা করেছিলেন? কেন করেছিলেন? সেই শুরু থেকে প্রশ্নগুলো অসংখ্য মানুষের মতো আমার মগজেও বসতি গড়েছে। এখন নানাভাবে সেগুলো ঘুরে ফিরে সংসার পাততে শুরু করেছে।
কী অপূর্ব নির্মাণশৈলী, কী অসাধারণ দক্ষতা। মাটির অন্তত ১শ’ ফুট নিচে এতগুলো গুহা কেন তৈরি করা হয়েছিল? একটি গুহার সাথে অন্য গুহার সংযোগ, গুহার ভিতরে সেতু, সুইমিং পুলের মতো জলাধার, পানি বের করে দেয়ার ব্যবস্থা সবই যেন আধুনিক স্থাপত্যশৈলি। অথচ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, গুহাগুলো অন্তত সাড়ে তিন থেকে চার হাজার বছর আগের। গুহার পিলারগুলো কী অসাধারণ দক্ষতায় স্থাপন করা, এত বছর পরও পাথরের পিলারগুলো অবলীলায় পাহাড়ের নিচে পাথরের ছাদ ধরে রেখেছে। গুহার দেয়ালে, পাথরের পিলারে এবং ছাদে কত ধরনের কারুকাজ যে করা হয়েছে! এতকিছু কেন করা হয়েছিল! কেন! কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আমার চোখের সামনে গুহার ভিতরের নানাকিছু ভাসছিল। এখন যেন আরো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গুহার ভিতর দিয়ে পাহাড়ে উঠে যাওয়ার ভয়ংকর সিঁড়ি। পা পিছলে পড়লেই মৃত্যু অবধারিত। অথচ শত শত মানুষ অন্যরকম উত্তেজনায় ভয়ংকর সেই সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠছে। আমরাও উঠেছিলাম। যদিও আমাদের গ্রুপ লিডার লায়ন ফজলে করিম, ঢাকার ব্যবসায়ী হেলাল ইউ আহমেদ ভাই আমাকে উপরে উঠতে না করেছিলেন। তবুও একটির পর একটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি। আমাদের সঙ্গীদের মধ্যে লায়ন আবদুল বারিক আগেই হাত তুলে দিয়েছেন। তিনি এমন সিঁড়ি ভেঙ্গে এই পাহাড়ে চড়তে পারবেন না। বিশাল পেট নিয়ে এত উপরে চড়া নাকি তারপক্ষে সম্ভব নয়। আবদুল বারিক ভাইয়ের চেয়ে আমার পেট বড়। আবার আমি বারিক ভাইয়ের চেয়ে অনেক মোটাও। বিষয়টি মুখে না বললেও লায়ন ফজলে করিম আমার পেট এবং মোটা শরীর নিয়ে শংকিত হয়ে উঠেন। সিঁড়ি থেকে পড়ে মরে টরে গেলে পুরো টিমই বিপদে পড়বে। তাই ভবিষ্যত শংকায় তিনি উপরে উঠার ব্যাপারে আমাকে নিরুৎসাহিত করছিলেন। কিন্তু আমি তো আমি! মাথায় যখন একবার গুহার সিঁড়িপথ ধরে পাহাড়ে চড়ার শখ চেপেছে, সেটি না হওয়া অব্দি স্বস্তি পাবো না। তাই অবশ্যই আমাকে গুহাপথের সিঁড়ি ভেঙ্গে পাহাড়ে চড়তে হবে। বাঁচা মরার ব্যাপারটি পরে। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় অসংখ্যবার দাবড়ানোর অভিজ্ঞতা যেহেতু রয়েছে তাই চীনের এই পাহাড় টপকানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হলাম না। একটি একটি করে সিঁড়ি ভাঙ্গছিলাম। একটু একটু করে উপরে উঠছিলাম। কী ভয়ংকর পথ চলা! কী রোমাঞ্চকর!! বুকের ভিতরটি টিপটিপ করছিল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। মুখও। শ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল। নিচের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল মাথা চক্কর দিচ্ছে। সামনে পেছনে বহু মানুষ। দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই। হেলান দিয়ে একটু আয়েশ খোঁজারও সাধ্যি নেই। একমাত্র পথ হচ্ছে সামনে চলা, কিংবা পড়ে মরে যাওয়া!
সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখার সাথে সাথে উত্তেজনায় এবং রোমাঞ্চে আমার সারা শরীর মন চনমন করে উঠেছিল। এভারেস্ট বিজয়ীদের শরীর মনে কেমন খেলা চলে তা জানার সৌভাগ্য আমার কোনদিনই হবে না, তবে চীনের এই গুহার সিঁড়ি মাড়িয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠাটা আমার কাছে এভারেস্ট জয়ের মতো রোমাঞ্চকর মনে হয়েছিল। আজীবন বহন করার মতো দারুণ এই স্মৃতি চীনের এই পাহাড়ি গুহা থেকে নিয়ে যাচ্ছি আমি।
খাওয়ার পর্ব সাঙ্গ হলো আমাদের। এবার আবারো ফিরতি পথে ছুটে চলা। গাড়িতে চড়লাম আমরা। পড়ন্ত বিকেল। কনে দেখা আলোয় ভরে উঠেছে চারদিক। চমৎকার এক পরিবেশ, প্রতিবেশ। ক্রমে দূরে সরে যাওয়া পাহাড়টাকে যে কী অসাধারণ লাগছে! মন ছুঁয়ে যাওয়া মোলায়েম একটি পাহাড়। সবুজে সবুজে একাকার। সুউচ্চ পাহাড়টি যেন মেঘের সাথে সখ্যতা করছে, ধরে আছে মেঘমালা। এই পাহাড়ের নিচেই অসংখ্য গুহা! যে গুহাগুলো কেন বা কারা তৈরি করেছিল তার পুরোটাই যুগের পর যুগ রয়ে গেছে অজানা।
বলতে ভুলে গেছি যে, গুহাগুলোর ভিতরে প্রচুর পানি ছিল। শুরুতে মনে করা হয়েছিল পুকুর। পানি সেচ করার পর সবাই খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে এতগুলো গুহার এত পানি সেচের পর একটি মাছও পাওয়া যায়নি। কতদিন ধরে এই পানি জমে ছিল সেই তথ্যও কারো কাছে নেই।
আমার মগজ থেকে গুহা সরছে না। সরছে না কল্পনার জগত থেকেও। কারা এই গুহা বানিয়েছিল? কেন বানিয়েছিল? কৃত্রিমভাবে হয়েছিল? এখন হচ্ছে না কেন? পাহাড়ের আর কোথাও নেই কেন? অনেকের ধারণা গুহাগুলো রাজার গোপন আস্তানা। তাহলে রাজা থাকতেন কোথায়, খেতেন কি, ঘুমাতেন কোথায়, রাণীদের অবস্থাও বা কি ছিল? কোথাও কোন চিহ্ন নেই। আবার কেউ কেউ বলেন, যুদ্ধবাজ রাজা শত্রুপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন, সৈন্যদের যুদ্ধ শেখাতেন, যুদ্ধ কৌশল রপ্ত করাতেন। তাহলেও একই প্রশ্ন, এতগুলো সৈন্য এখানে কোথায় কিভাবে থাকতো? কোন চিহ্নতো নেই। আবার যুদ্ধ করতে হলে দেয়ালে, পিলারে, ছাদে এত কারুকাজের কি দরকার ছিল? এগুলো করতে করতে তো যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা! যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ কোনকিছুতেই কোন সম্ভাবনা মিলেনা। বাকি থাকে শুধু ভিনগ্রহের এলিয়ন কিংবা জ্বীন। যার আবার কোন প্রমাণ মিলে না। কোথাও কোন চিহ্ন নেই, কোন যন্ত্রপাতি নেই, কোন খাবার দাবার নেই, নেই কোন বসবাস বা বাসরের চিহ্ন। তাহলে! বিরাট প্রশ্নটিই ঘুরপাক খাচ্ছে। ছুটছে আমাদের গাড়ি, পাহাড়ী পথ পার হয়ে সমতলের রাজপথ ধরে আমরা ছুটছি তাইজু শহরে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধবাবার খুশি