প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২২ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারীতে আজমীরে যেয়ারত

গত ২ বছর যাবৎ বিশ্বে করোনা মহামারী চলমান। চলতি বছর মার্চ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতে করোনা মহামারী কমে আসায় নিয়ম নীতিতে শিথিলতা আনা হয়। ফলে কলকাতা-দিল্লি-আজমীর গমনের লক্ষে নতুনভাবে ভারতের ভিসা সংগ্রহ করি। অতঃপর জানতে পারি দু’বছর পর দেশে চলতি রমজানে দোকানপাট খোলা থাকবে বিধায় হাজার হাজার দেশীয় ব্যবসায়ী কলকাতা থেকে মালামাল আনতে চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়া-আসার প্রায় সব বিমান টিকেট কিনে নিয়েছে।

জানি না কোটি কোটি টাকায় ক্রয়কৃত মালামাল দেশে বৈধভাবে নাকি অবৈধভাবে ঢুকছে।

কলকাতা গমন কঠিন হওয়ায় রমজানের ঈদের পর কলকাতা গমনের প্রোগ্রাম রাখি। এতে কলকাতার পাশাপাশি ফুরফুরা ও বান্ডেল শরীফ যাওয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
আপাতত রমজানের আগে দিল্লি হয়ে আজমীরের প্রোগ্রাম ঠিক রাখি। সম্প্রতি ভারত সরকার অন্যান্য যাত্রীদের সাথে আজমীরে যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে ছোট বিমান বন্দর চালু করে।

আজমীর মাজার কমপ্লেক্স থেকে বিমান বন্দর ২০ কি.মি দূরত্বে; এ বিমান বন্দর এলাকাটির নাম কিষানগড়। এখান থেকে দৈনিক একটি ফ্লাইট দিল্লি আসা-যাওয়া করে।

গত ২৮ মার্চ সোমবার দুপুরের দিকে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে ঐ দিন বিকেলবেলা দিল্লি থেকে কিষানগড় হয়ে আজমীর পৌঁছার প্রোগ্রাম করি। আজমীরে ২ রাত থেকে ৩০ তারিখ বিকেলের ফ্লাইটে দিল্লি এসে তারপর দিন দুপুরের ফ্লাইটে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা আসার টিকেট খরিদ করা হয়।
করোনা মহামারী কিছুটা কমে আসায় উভয় সরকারের আইন কানুনে কিছুটা শিথিলতা আসে। করোনা ২ ডোজ টিকার সার্টিফিকেট প্রদর্শন করতে পারলে চলবে। আমার বুস্টার ডোজ তথা তৃতীয় ডোজও দেয়া আছে।

ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে কাউন্টারে করোনা সার্টিফিকেট দেখল মাত্র। প্রায় পূর্ণ যাত্রী নিয়ে ৭৩৭ ছোট বোয়িং বিমান ২ ঘণ্টার যাত্রায় দিল্লির উদ্দেশ্যে আকাশে উড়াল দেয়। ভাগ্য ভাল বিমান ১ ঘণ্টার অধিক বিলম্ব করেনি।

করোনা মহামারী চলাকালীন ২ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার দেশ থেকে বের হওয়া। তার আগে প্রথমবার গত বছর অক্টোবরে প্রায় ২৪ দিনের জন্য ওমরাহ ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যাওয়া হয়েছিল।

দিল্লি যাত্রায় বিমানের অভ্যন্তরে মাস্ক পরড়া কড়াকড়ি ছিল না। তবে প্রায় ২ ঘণ্টার যাত্রা হিসেবে বাংলাদেশ বিমানের আতিথেয়তা চমৎকার।

দিল্লি বিমান বন্দরে নামলেই আইন কানুনের কড়াকড়ি প্রত্যক্ষ করি। প্রায় সকলের মুখে মাস্ক। ইমিগ্রেশনে করোনা টিকার সার্টিফিকেট দেখল।

দিল্লি বিমান বন্দরে ৩টি টার্মিনাল। এ ৩ নং টার্মিনাল শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক। সাথে স্বল্প সংখ্যক আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও চলমান। ৩ ও ২ নং টার্মিনাল কাছাকাছি। ভিতর দিয়ে ট্রলি নিয়ে ২ ও ৩ নং টার্মিনালে যাওয়া-আসা করা যায়। গত ২০১৯ নভেম্বরে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দ থেকে দিল্লিতে ৩ নং টার্মিনালে নামা হয়। কলকাতার আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছিল ২ নং টার্মিনাল থেকে। তখন প্রায় ২ শত মিটার দূরত্বে ভিতর দিয়ে ট্রলি নিয়ে ২ নং টার্মিনালে আসা হয়েছিল। কিন্তু দিল্লি থেকে আজমীরে যেতে আমাদের আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট হল ১নং টার্মিনাল থেকে। যা ৪/৫ কি.মি দূরত্বে। লাগেজ নিয়ে ১নং টার্মিনালে যেতে হচ্ছিল। সহজ মাধ্যম সাটল বাস। ৩নং টার্মিনাল থেকে বের হয়ে সাটল বাসে উঠলাম, কিন্তু ভাড়া নিল ২৫ রুপি যা অগ্রহণযোগ্য। বিশ্বে বড় বড় বিমান বন্দরগুলোতে এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতে সাটল বাস ও ট্রেনের ব্যবস্থা আছে; যা সম্পূর্ণ ফ্রি বলা যাবে। দিল্লির মত বিশ্বে অন্য কোন বিমান বন্দরে সাটল বাসে টাকা নেওয়ার প্রচল আছে কিনা তা আমার অজানা।

১নং টার্মিনাল থেকে স্পাইস জেটে আজমীর গমন করি। তাদের ব্যবস্থাপনা চমৎকার। কিন্তু এখানেও মাস্কের কড়াকড়ি। এটিপি এটিআর ৮৮ জন যাত্রী বহনে সক্ষম ছোট বিমানে ৪০ মিনিটের যাত্রা। বোডিং কার্ডে লেখাটা ভৎড়স উবষযর ঃড় অলসবৎ। কিন্তু বিমানের ভিতর ঘোষণা দিল দিল্লি থেকে কিষানগড় যাচ্ছি। বিকেলের একটি ফ্লাইট, যাত্রী পরিপূর্ণ। দিল্লি বিমান বন্দরে যোহরের নামাজ, কিষানগড় বিমান বন্দরে আছরের নামাজ পড়া হল।

আজমীর হোটেলের পক্ষ থেকে টেক্সী পাঠানো হয়। টেক্সীর ড্রাইভারও মাস্ক পরা।

কিন্তু আজমীর পৌঁছেই দেখতে পেলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এখানে শতকরা ৫ জনের মুখেও মাস্ক নাই। যেমনি হোটেল, পথে, তেমনি মাজার কমপ্লেক্সের ভিতরে।
আমরা মুসলমানেরা অসচেতন। নিয়ম শৃংখলার তোয়াক্কা করি না।

আজমীরের হোটেলটি মাজার কমপ্লেক্সের প্রধান গেইটের মাত্র শত মিটার পশ্চিমে। শুক্র, শনি, রবি যেয়ারতকারীদের ভিড় বেশি থাকে। সোম এবং মঙ্গলবারও যেয়ারতকারীর ব্যাপক সমাগম।

নিজে মাস্ক পরে নামাজে যেয়ারতে অবস্থানে থাকলেও অপরাপর কারও মাস্ক না থাকায় নিজেকে নিজে বিব্রতকর মনে হচ্ছিল।

আজমীরে অবস্থানকালে প্রশাসনিক অফিসে যাওয়া হয় নিয়ম নীতি পরিবর্তন-পরিবর্ধন অবগত হতে।

আজমীর মাজার কমপ্লেক্স নিয়ে রয়েছে ত্রিমুখী নিয়ন্ত্রণ।

১) সরকারী কর্মকর্তা প্রশাসক যার পদবী নাজিম। তাকে সহায়তা করবে ৫ বছরের জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। এসব কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। প্রশাসক ও কমিটি মাজার কমপ্লেক্সের রক্ষণাবেক্ষণ আয়-ব্যয় হিসাব নিয়ন্ত্রক।

২) হযরত গরীবে নওয়াজের মূল আওলাদ। যিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়নকৃত প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন ও সুরক্ষা দেয়া হয় তাকে।
৩) খাদেমগণ। বর্তমানে তাদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা বেড়ে ৮/১০ হাজার প্রায়। তারা দৈনিক হাজার হাজার যেয়ারতকারীগণকে ধর্মীয় সহায়তা দিয়ে থাকেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে অনৈসলামিক কার্যকলাপ শিরক, বেদআত থেকে মুক্ত নয়।

শত বছরের অধিককাল হতে খাদেমগণ মাজার কমপ্লেক্স এরিয়ায় অবস্থান করে যেয়ারতকারীগণকে সহযোগিতা করে আসছেন। যেয়ারতকারীগণও খাদেমগণের ঘরে থেকে খেয়ে সহযোগিতা পেয়ে আসছিলেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মাজার কমিটির বক্তব্য মতে তাদের সংখ্যা প্রায় ৮/১০ হাজার। তাদের ঘরে যেয়ারতকারীগণকে ব্যাপক হারে রাখার মত অবস্থা নেই। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কমিটির তত্ত্বাবধানে বিশাল বিশাল গেস্ট হাউস। আরও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে শত শত আবাসিক হোটেল, অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। এ ক্ষেত্রে কমিটির দায়িত্ব হবে খাদেমগণের হাজার হাজার সন্তান-সন্ততিকে প্রোভাইট করা। ভারতের সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিয়ে সরকারীভাবে করা যায়। নতুবা দিল্লিতে রয়েছে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রীয় ৬টি দেশের দূতাবাস। তাদেরকে বিষয়টি অনুধাবন করাতে পারলে তাদের দেশে খাদেমগণের সন্তান-সন্ততিদের প্রোভাইট করা খুব সহজ ব্যাপার।

আজমীরে ২ রাত অবস্থান করে ৩০ মার্চ বুধবার বিকেলে বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হতেই টেক্সি চালকের মুখে মাস্ক। কিষানগড় বিমান বন্দরে এবং বিমানের অভ্যন্তরে মাস্কের কড়াকড়ি।

বিমান বন্দরের প্রধান কর্মকর্তাকে অনুরোধ করি উচ্চপদস্থকে অবহিত করতে যাতে ছোট কলেবরে হলেও নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়। যেহেতু এখানে আসরের নামাজ পড়তে কষ্ট হচ্ছিল।

কিষানগড় ছোট বিমান বন্দর। বিকেলে দৈনিক দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইট আসা-যাওয়া করে। সুরাট, আহমদাবাদ, বেঙ্গালুর যাতায়াতের ফ্লাইট রয়েছে। আমাদের দেশ থেকে ব্যাপক সংখ্যক যেয়ারতকারী আজমীরে যাওয়া-আসা করে। কলকাতা ও ঢাকা থেকে কিষানগড় ফ্লাইট চালু করা যেতে পারে।

দিল্লি থেকে আসা স্পাইস জেটের ছোট বিমানে কিষানগড় থেকে দিল্লি যাত্রা করি।

দিল্লি ১নং টার্মিনাল থেকে টেঙী নিয়ে সরাসরি হোটেলে চলে যাই। এখানে সব ক্ষেত্রে মাস্ক এর কড়াকড়ি।

এ টেঙী যোগে পরদিন বৃহস্পতিবার ভোরে যেয়ারতে বের হই। খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ.), মুল্লা জীবন (রহ.), শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.), শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.), শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.), কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.) এর যেয়ারত করে হোটেলে ফিরে আসি। সকাল ১০ টার দিকে নাস্তা করে বিমান বন্দর যাওয়ার পথে খাজা নেজাম উদ্দিন (রহ.)’র যেয়ারত করা হয়।

যথাসময়ে বিমান বন্দরের ৩নং টার্মিনালে আসা হলেও বিমান ছাড়তে ১ ঘণ্টা দেরি হয়। বিমানের অভ্যন্তরে মাস্কের কড়াকড়ি নেই। ২ ঘণ্টার যাত্রা হিসেবে আতিথেয়তা গ্রহণযোগ্য।

ঢাকায় নেমে বিড়ম্বনায় পড়ি। বিমান বন্দরে পাকিং খালি না থাকায় যাত্রীদেরকে বিমানের ভিতর বসায়ে রাখে প্রায় ২০ মিনিট। অতঃপর ডমেস্টিক যাত্রীদের ওখানে নামিয়ে দেয়। তথা হতে বাসে টার্মিনালে গমন। লাগেজ পেতে সময় নেয়। এতে নির্ধারিত সময়ের ২ ঘণ্টার অধিক বিলম্ব হওয়ায় রাতের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা সম্ভব হল না। পরদিন শুক্রবার সকালের ফ্লাইটে আসতে হল।

বস্তুতঃ করোনা মহামারী ভয়াবহ অবস্থায় আজমীরে প্রায় ৬-৭ মাস সব কিছু বন্ধ ছিল। তথা মাজার কমপ্লেক্স, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে এ নির্দেশনায় শীতলতা এসে যায়। এতে ভারতের অন্যান্যরা করোনা মহামারীর নিয়মনীতি মানলেও, আজমীরে মুসলমানের মুখে মাস্ক পরার কোন তোয়াক্কা নেই। ভারতের মুসলমানদের উচিত হবে করোনা স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশনাকে সম্মান করা অনুসরণ, অনুকরণ করা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপে ৩ রোহিঙ্গা আটক
পরবর্তী নিবন্ধর‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী