প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

জমজমের পানি পান

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র পুত্র ও নবী হযরত ইসমাইল (আ.)’র মাধ্যমে জমজম কূপ আবিষ্কৃত হয়। মহান আল্লাহ পাকের এ এক অলৌকিক নিদর্শন। এ কূপ পবিত্র কাবার দক্ষিণ পূর্ব দিকে ২০/২৫ ফুট ব্যবধানে। পবিত্র জমজম কূপের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।
তবে আজ সম্মানিত পাঠক মহলে উপস্থাপন করছি আমার জীবনে শিশুকাল থেকে দেখে আসা জমজমের পানি পান করা নিয়ে।
১৯৫০ এর দশকে ১৯৫৬/৫৬ সাল থেকে ১৯৬০/৬১ সাল পর্যন্ত শিশুকালে দেখতাম বাঁশখালী আমাদের গ্রামের বাড়ীতে পবিত্র আরব ভূমি থেকে আরবীয়গণ আসতেন ৩/৪ জন গ্রুপ করে। কমপক্ষে ২/৩ রাত বা ৪ রাত থাকতেন। আব্বাজান তাদেরকে যথাযথ সম্মান রক্ষা করে আতিথেয়তা করতেন। ঘরে তাঁদের জন্য আরবীয় খাবার প্রস্তুত করাতে সচেষ্ট থাকতেন।
আরবীয়গণ আসতেন কাঁধে বহনযোগ্য বড় একটি গাট্টি নিয়ে। তখন একালের মত ব্যাগের প্রচলন তেমন ছিল না। তাদের গাট্টির মধ্যে কাপড়ের ছোট ছোট দু’টি থলের মথ্যে একটির মধ্যে ছোট ছোট ২০/২৫টি তাসবীহ, আরেক ছোট থলেতে হয়ত আধা কেজি মত শুকনো খেজুর থাকত। একটি ছোট কাচের বোতল, হয়ত একালের ৩ শ মিলিলিটার মত হতে পারে। ঐ কাচের বোতলে পানি। আরবীয়গণ আসলে বাড়ীর লোকজন কয়েকটি কলসি করে খাবারের পানি নিয়ে আসতেন। এতে আরবীয়গণ ঐ কাচের বোতল থেকে সাবধানে ২/১ ফোঁটা করে ঐ বোতল থেকে পানি ফেলতেন। বাড়ীর লোকজন তৎমধ্যে ১ বা ২ টি কলসি আন্দর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতেন। বাকী কলসিগুলো থেকে জগে পানি নিতেন। আরবীয়গণ আসলে কাছারী বাড়ীতে পুরুষ, আন্দর বাড়ীতে মহিলা গিজগিজ করত। বাড়ীর কাজের লোকজন জগ থেকে ছোট ছোট পটে বা গ্লাসে অল্প পানি প্রায় ৬০/৭০ মিলিলিটার থেকে ১০০ মিলিলিটার করে পানি দিত খাওয়ার জন্য। আগত ব্যক্তিগণ কেবলামুখী দাড়িয়ে পায়ে স্যান্ডেল থাকলে তা খুলে মাথায় টুপি না থাকলে সম্ভব হলে টুপির ব্যবস্থা করে ৩ বার করে তথা ৩ ঢোক করে ঐ পানি পান করতেন। আন্দর বাড়িতেও কাজের মহিলারা আগত মহিলাগণকে এভাবে পানি পান করাতেন। মহিলারাও অতি তাজিমের সাথে পানি পান করতেন। পুরুষ মহিলাগণ প্রত্যেকে যার যার তাওফিক মত ১ পয়সা থেকে ১ আনা, সম্ভব হলে ৮ আনা বা ১ টাকা আরবীয়গণকে দিতেন। বয়স্ক মহিলাগণ নিজেদের ব্যবহৃত স্বর্ণ দিয়ে দেয়ার প্রবণতা ছিল বেশি। আরবীয়গণ কাচের বোতলে করে নিয়ে আসা এ পানি পবিত্র জমজমের। তবে জমজম কূপ, কূপের পানি এ বিষয়ে বুঝার বয়স তখন আমার হয় নিই, যা ছিল ১৯৫৫/৫৬ সালের দিকে।
এভাবে আরবীয়গণ হজ্বের পর দফায় দফায় আসতেন। সাথে কাচের বোতলে জমজমের পানি থাকত। তারা আসলে কাছারীতে পুরুষ, আন্দর বাড়ীতে ব্যাপক মহিলার সমাগম হত। কয়েকজন সচ্ছল সম্ভ্রান্ত পরিবারের কয়েকজন দেখলে তাদের ঘাটলি থেকে একটি শুকনো খেজুর নিয়ে ৫/৭ টুকরা করে এক এক টুকরা এক এক জনকে খেতে দিতেন। যে বাড়ীতে তারা অবস্থান নেয় সেই বাড়ীর কর্তাকে হয়ত একটি তাসবীহ এর ছড়া দিতেন।
সৌদি জনগণের আর্থিক অবস্থা দ্রুত সচ্ছলের দিকে যাওয়ায় ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিক থেকে আমাদের দেশে সৌদি লোকজন আসা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬০ এর দশকে পানির জাহাজে হজ্বযাত্রীগণ হজ্বের পর দেশে আসতে টিনের কনটেইনার করে ১০/১৫ লিটার জমজমের পানির নিয়ে আসতেন। এ কনটেইনারে জমজমের পানির টিনের কনটেইনার পবিত্র মক্কায় ঝালায় করে নিত। পানির জাহাজে করে ওজনে বিমানের মত সীমাবদ্ধতা ছিল না। হজ্বযাত্রী দেশে আসলে জমজমের টিনটি সাবধানের সাথে খোলা হত। পাত্রে অল্প অল্প পানি নিয়ে বড় বড় পানির কলসিতে অল্প অল্প করে ঢালা হত।
সেই সময় হজ্বযাত্রীগণের কাছে প্রতিদিন অগনিত মানুষ দোয়া প্রার্থী হয়ে আসত। তাদেরকে কলসি থেকে ছোট গ্লাসে বা পটে পানি নিয়ে খেতে দিত। ১৯৬০ এর দশকেও হজ্বযাত্রীগণকে দেখতে আসা লোকজন কেবলামুখী দাড়িয়ে জুতা স্যান্ডেল খুলে দোয়া দরূদ পড়ে তিন ঢোকে এ পানি পান করতেন। হাজী সাহেব টিনের কনটেইনার অবশিষ্ট পানি পরিমাণ মতে কাচের বোতলে করে ঘরে রেখে দিতেন।
ব্রিটিশ আমল ত বটেই পাকিস্তান আমলেও কোন নর-নারীর ইন্তেকালের সময় আন্দাজ করে ছোট পাত্র নিয়ে হাজী সাহেবের ঘরে দৌড়াদৌড়ি পড়ত সামান্য জমজমের পানি পেতে। যাতে মৃত্যুপথযাত্রী নর-নারীর মুখে কয়েক ফোঁটা জমজমের পানি দেয়া যায়।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৫ সালে আমার হজ্বে গমন করার সৌভাগ্য হয়। তখন দেখতাম মসজিদুল হারমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইয়েমেনীরা কাতারে কাতারে হেঁটে হেঁটে ছোট ছোট পটে করে হজ্বযাত্রীগণকে জমজমের পানি দিত। তাদের কাঁধে থাকত বড় চামড়ার ব্যাগ অথবা মাটির লম্বাকৃতি কলসি। তাদের কাঁধের উপর থাকা ব্যাগ বা কলসি সামনের দিকে ঝুলিয়ে পটে জমজমের পানি নিয়ে হজ্বযাত্রীগণকে দিতেন। হজ্বযাত্রীরা ন্যূনতম এক রিয়াল করে দিত। অবশ্য হজ্ব মৌসুমে তাওয়াফ করতে গেলে জমজমের কূপে গিয়ে ওখান থেকে পানি খেত। কিন্তু লাখ লাখ নামাজীর মধ্যে রিয়াল বাচানোর জন্য ব্যাপক সমাগম অতিক্রম করে জমজমের পানি খাওয়ার জন্য জমজম কুপে যেতে কষ্টসাধ্য ছিল। অপরদিকে ইয়েমেনীরা জমজমের পানি খাওয়ানোর মাধ্যমে তাদের রোজগারের ব্যবস্থা করেছিল। হাজীরা কনটেইনার কিনে জমজম কূপ থেকে পানি নিয়ে রাখতেন দেশে আসার সময় আনার জন্য।
১৯৮০ দশকের শেষের দিকে অথবা ১৯৯০ দশকের প্রথমে বাদশাহ ফাহাদের উদারতায় মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববীতে নামাজীরা যাতে হাত টানলেই জমজমের পানি পায় তা ব্যবস্থা করা হয়। সে লক্ষ্যে পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনার জমজমের পানি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এদিকে নিরাপত্তার খাতিরে জমজমের কূপ ঢেকে দেয়া হয়। অপরদিকে নবী পাক (স.)’র জন্মস্থানের দক্ষিণ সংলগ্ন জমজমের পানির ১৫/২০ টা ট্যাপ বসানো হয়েছে। হজ্বযাত্রী দেশে আসার আগে ৫/১০ লিটারের প্লাস্টিকের কনটেইনার কিনে নিতেন। এ কনটেইনার নিয়ে তথাকার জমজমের পানি ভর্তি করে রেখে দিতেন দেশে আসলে নিয়ে আনার জন্য। অনেকে ২০ লিটারের কনটেইনার করেও পানি আনতেন।
বর্তমানকালে জমজম বিষয়ক কর্তৃপক্ষ ৫ ও ১০ লিটারের কনটেইনার করে জমজমের পানি প্যাক করতেছেন যাতে হজ্বযাত্রীরা এ পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেতে পারে। তৎমধ্যে ১০ লিটার খুবই কম, ৫ লিটার কনটেইনার ব্যাপক ও সহজলভ্য। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় বিভিন্ন দোকানে ৫/৭ রিয়াল হাদিয়ার বিনিময়ে এ জমজমের পানি ভর্তি কন্টেইন বিক্রি করছে। তেমনিভাবে বিক্রি করছে বিখ্যাত সুপার মার্কেট বিন দাউদ যা উভয় পবিত্র নগরীতে হজ্বযাত্রীগণের নিকট অতি প্রসিদ্ধ। এদিকে বাংলাদেশ বিমান হজ্ব ফ্লাইট চালু করলে হজ্বের পর দেশে পৌঁছলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে একটি করে ৫ লিটারের জমজমের কন্টেইনার দিত। তবে ওমরাহর ক্ষেত্রে জমজমের পানি ৫ লিটারের একটি কন্টেইন কিনে নিয়ে আসতে পারেন। এর জন্য বিমান কোন চার্জ নেয় না। বর্তমানে করোনা মহামারীর কারণে সৌদি জমজম কর্তৃপক্ষ ৫/১০ লিটারের পাশাপাশি ৩৩০ মিলিলিটার ও ২০০ মিলিলিটার ছোট ছোট জমজমের পানির বোতল পবিত্র মক্কায় তাওয়াফকারী ও পবিত্র মদিনায় নামাজীগণকে প্রদান করতেছে। তবে এ ছোট বোতল প্রদান প্রথা কতদিন স্থায়ী হবে তা অজানা। মহান আল্লাহ পাকের অলৌকিক এ জমজমের পানি বিশ্বের ১৩০ কোটি মুসলমান ত বটেই, অন্যান্য ধর্মাম্বলীর মধ্যে অনেকেরই আগ্রহ এ জমজমের পানি পেতে। মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে বারে বারে জমজমের পানি পান করতে তাওফীক দান করুক। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহাবীর মাস্টারদা সূর্যসেন ও আমাদের স্বাধীনতা
পরবর্তী নিবন্ধবিভিন্নস্থানে শীতবস্ত্র বিতরণ