প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে চায় বিএনপি, মেয়াদ টানা দুইয়ের বেশি নয়

রাষ্ট্র মেরামতে যৌথ রূপরেখায় ৩১ দফা

| শুক্রবার , ১৪ জুলাই, ২০২৩ at ৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সরকার পদনের ‘এক দফা’ দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার পরদিন রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করল বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে একে যৌথ রূপরেখা বলছে দলটি। গতকাল বৃহস্পতিবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই রূপরেখা ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন।

মির্জা ফখরুলের এই ঘোষণা গত ১৯ ডিসেম্বরের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। সেদিন বিএনপির পক্ষ থেকে ২৭ দফা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেটিকেও রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা হিসেবে তুলে ধরেছিল দলটি। প্রায় সাত মাস পর নতুন এই ঘোষণায় চারটি প্রতিশ্রুতি বাড়ানো হয়েছে, বাদ পড়েছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রসঙ্গ। এর আগে বিএনপি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছিল, এবার মন্ত্রিসভায় ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছে। আগের ঘোষণার মতই সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সীমা বেঁধে দেওয়া, বেকার ভাতা চালু, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে কমিশন গঠনের কথা বলা আছে এতে। সরকার পরিচালনা ও নির্বাচন ছাড়াও বিচার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে বিশেষ উদ্যোগ, প্রশাসনিক সংস্কার এবং কৃষক ও শ্রমজীবীদের নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও এখানে রয়েছে। খবর বিডিনিউজের।

মির্জা ফখরুল বলেন, তারা যে এক দফা দাবি ঘোষণা করেছেন, সেটি কেবল সরকার পরিবর্তনের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে চান। রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক হিসেবে গড়ে তুলতে যারা যুগপৎভাবে আন্দোলনে আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রূপরেখাটি জাতির সামনে আবার তুলে ধরার কথা বলেন তিনি। তবে এটিই চূড়ান্ত নয়, তাও জানিয়ে দেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসতে পারে, সেটাও সময়ের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আসতে পারে।

৩১ দফার এই রূপরেখা ঘোষণার আগে মির্জা ফখরুল বলেন, রাষ্ট্রের মালিকানা আজ জনগণের হাতে নাই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনঃগঠন করতে হবে। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারলে বর্তমান সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐক্যমতের সরকার’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দেন বিএনপি মহাসচিব। বলেন, উক্ত জাতীয় সরকার রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে।

মন্ত্রিসভায় ক্ষমতার ভারসাম্য, সংসদে উচ্চকক্ষ : বর্তমান সরকার সাংবিধানে যেসব সংস্কার করেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করতে ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করতে চায় বিএনপি। এর মাধ্যমে ‘বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক’ সংশোধনী বাতিল ও সংশোধন এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করার কথা বলেছে তারা। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থাও পুনঃপ্রবর্তনের কথা জানান ফখরুল। পঞ্চম ধারায় বলা আছে, ‘পরপর দুই টার্মের (মেয়াদের) অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করিতে পারিবেন না।’

জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ তৈরি করতে চায় বিএনপি। সেখানে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসপন্ন ব্যক্তিদের নেওয়া হবে।

ফিরবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার : রূপরেখার তৃতীয় ধারায় ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানোর প্রতিশ্রতি আছে। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করার কথাও বলা হয় এতে। ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ভোট নেওয়া, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিলের কথাও আছে রূপরেখায়।

রিকনসিলেশন কমিশন : ‘প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের’ রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও করেন ফখরুল। এজন্য আলোচনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছতে একটি ‘রিকনসিলেশন কমিশন’ গঠনের কথা বলেন তিনি।

ফিরবে পাচার হওয়া অর্থ : এই অঙ্গীকার তুলে ধরে গত দেড় দশকের অর্থপাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে শ্বেতপত্র প্রকাশ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন ফখরুল। তিনি বলেন পাচার করা অর্থ দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংস্কার এবং দুদকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগের কথাও বলা হয়েছে রূপরেখায়।

অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন, প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনীদরিদ্রের বৈষম্য দূরী করার কথা বলা আছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইন বাতিল, কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে দুর্নীতি বন্ধ। আমদানিনির্ভরতার বদলে নবায়নযোগ্য ও মিশ্র জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেন ফখরুল।

বন্ধ হবে বিচারবহির্ভুত হত্যা : সার্বজনীন মৌলিক মানবাধিকারের ঘোষণা অনুযায়ী দেশে মানবাধিকার বাস্তবায়ন, ‘গুম’, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকারও আছে এতে। গত দেড় দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের সুবিচার নিশ্চিত করার কথাও বলেন ফখরুল।

মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী মজুরি, বেকার ভাতা : শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে প্রাইস ইনডেঙ বিবেচনায় নেওয়া, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা, পাটবস্ত্রচিনিসহ বন্ধ সব শিল্প আবার চালু, প্রবাসী কর্মীদের মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বৈষম্য দূর করে সুষম উন্নয়নে ‘বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের কথা বলেছেন ফখরুল।

এক বছর অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান, বেকারত্ব দূর করতে বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ, মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করার কথাও বলেন ফখরুল। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনায় নেওয়ার কথাও তিনি বলেন।

শিক্ষা স্বাস্থ্যে জিডিপির ১০ শতাংশ : জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ, চাহিদাভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য, গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, একই মানের শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথাও বলা আছে রূপরেখায়।

সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ও ‘বিনা চিকিৎসায় কোন মৃত্যু নয়, নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের আলোকে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালুর অঙ্গীকারও করেন ফখরুল। জাতীয় বাজেটে জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতেও বরাদ্দ হবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধা বঞ্চিত হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো সম্প্রসারিত করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৯৫ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা
পরবর্তী নিবন্ধসংলাপ নিয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত হবে না যুক্তরাষ্ট্র