প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন

কার্যকর কাল থেকে

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হলে বিশ্বে সব ধরণের জ্বালানির দাম কমে যায়। শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এক এমএমবিটিইউ (তরলীকৃত জ্বালানি পরিমাপের একক) এলএনজির দাম তিন ডলারের নীচে নেমে যায়। সময়ের ব্যবধানে আবার বেড়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম। বছরের ব্যবধানে বিশ্ব বাজারে প্রায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে এলএনজির দাম। এতে ভর্তুকিও বেড়েছে। এ ভর্তুকি ঠেকাতে গত দুই মাস ধরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখে সরকার। আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য শিল্প ও বিদ্যুতে গ্যাসের রেশনিং শুরু হয়। এতে ফার্নেস অয়েল নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলমান থাকায় বিদ্যুতে সমস্যা তৈরি না হলেও শিল্পের উৎপাদনে ব্যাঘাত শুরু হয়। যে কারণে শিল্প ও বিদ্যুতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে সিএনজি স্টেশনগুলোতে রেশনিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আগামীকাল বুধবার থেকে বিকেল ৫টা হতে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলো বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত এক সভায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে (পিক আওয়ারে) সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ওই সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই বুধবার থেকে প্রতিদিন বিকেল ৫টা হতে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। দৈনিক পিক আওয়ারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহের জন্যই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিকেল ৫টা হতে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশন বন্ধ থাকবে।
সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি, এলপিজি ও তরল জ্বালানির দাম হু হু করে বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ১৭-১৯ ডলারের মধ্যে উঠানামা করছে। অথচ গতবছরের অক্টোবরের শুরুতে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল ৭ ডলারের কমবেশি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী সদ্য বিগত অর্থবছরে শুধু এলএনজি আমদানিতেই ভর্তুকি দিতে হয়েছে পৌনে তিন হাজার কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী দাম বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে গত দুই মাস ধরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয় সরকার। কারণ আমদানি শুরুর পর থেকে বাংলাদেশকে এবারই সর্বোচ্চ দামে কিনতে হচ্ছে। এতে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য শিল্পে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে নতুন করে সমস্যা তৈরি হয় শিল্পের উৎপাদনেও। কারণ শিল্প উৎপাদনে বিগত কয়েকবছর ধরে শত শত ক্যাপটিভ পাওয়ার বসিয়েছেন উদ্যোক্তারা। যার বেশিরভাগ জ্বালানি হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস।
কেজিডিসিএল সূত্রে জানা যায়, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পখাত মিলিয়ে চট্টগ্রামে গ্যাসের গ্রাহক রয়েছে ৬ লাখের বেশি। তন্মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ৫ লাখ ৯৮ হাজারের কাছাকাছি। তাছাড়া শিল্প গ্রাহক রয়েছে ১১২৭, বাণিজ্যিক গ্রাহক ২৮৬২, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১৯০, সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন ৭০টি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫টি ও সার কারখানা রয়েছে ৪টি। সবমিলিয়ে চট্টগ্রামে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা থাকে ৪৮০-৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এলএনজি আমদানির আগে চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রামে মাত্র ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম গ্যাস সরবরাহ দেয়া হত।
এদিকে চট্টগ্রামের ২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গত ৭ দিনের মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর ১৪১০ মেগাওয়াট, ১১ সেপ্টেম্বর ১৫০২ মেগাওয়াট, ১০ সেপ্টেম্বর ১৪৪৮ মেগাওয়াট, ৯ সেপ্টেম্বর ১৫০৩ মেগাওয়াট, ৮ সেপ্টেম্বর ১৪৩৩ মেগাওয়াট , ৭ সেপ্টেম্বর ১৪৭০ মেগাওয়াট এবং ৬ সেপ্টেম্বর ১৪৫৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ২২৫ মেগাওয়াট শিকলবাহা রিসাইকেল পাওয়ার প্লান্ট, ১৫০ মেগাওয়াট শিকলবাহা ডুয়েল ফুয়েল পাওয়ার প্লান্ট ও রাউজানের ২১০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল ছিল। তথ্য অনুযায়ী এই সময়ে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে পিডিবি। এসময় দেশে কোনো লোডশেডিং ছিল না বলে পিডিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে, বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলা হলেও মূলত শিল্পের ক্যাপটিভ পাওয়ারের জন্যেই গ্যাসের সরবরাহ বাড়াবে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুই মাস ধরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মহেশখালীর দুই এফএসআরইউ থেকে এলএনজি সরবরাহ কমে যায়। বর্তমানে এলএনজি থেকে রূপান্তরিত করে ৬ মিলিয়নের মতো ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে এলএনজি আমদানির পর মহেশখালীর দুই এফএসআরইউ থেকে সক্ষমতার সর্বোচ্চ এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ শুরু হলে তিনশ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ পেয়েছিল কর্ণফুলী গ্যাস। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ সেপ্টেম্বর ২৮১.৮ মিলিয়ন ঘনফুট, ১১ সেপ্টেম্বর ৩০৩.৮ মিলিয়ন ঘনফুট, ১০ সেপ্টেম্বর ২৬৩.৩ মিলিয়ন ঘনফুট, ৯ সেপ্টেম্বর ২৯৪.৮ মিলিয়ন ঘনফুট, ৮ সেপ্টেম্বর ৩০০.৮ মিলিয়ন ঘনফুট, ৭ সেপ্টেম্বর ২৯৪.৮ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ৬ সেপ্টেম্বর ২৯৫.৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস। তাছাড়াও দেশের প্রত্যেকটি শিল্পজোনে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে। এ ক্যাপটিভ পাওয়ারের বিদ্যুৎ দিয়েই শিল্পের উৎপাদন সচল রাখা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকায় স্পট মার্কেট থেকে আমরা এলএনজি আমদানি শুরু করেছিলাম। কিন্তু গত এক বছর ধরে বিশ্ববাজারে অন্য জ্বালানির মতো এলএনজির দাম হু হু করে বেড়েছে। এতে সরকারি সিদ্ধান্তে দুই মাস ধরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে না। এতে গ্যাসের কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ১৭-১৯ ডলারে উঠানামা করছে। এটা কখন কমবে তার কোন পূর্বাভাসও নেই। তাই পিকআওয়ারে সিএনজি স্টেশনগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসময় শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়া হবে।’
এদিকে সিএনজি স্টেশনগুলো বন্ধের বিষয়ে জানতে কথা হয় নগরীর খুলশী ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার মো. হাসানের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা টিভির স্ক্রলে বুধবার থেকে সিএনজি স্টেশন ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখার বিষয়টি শুনেছি। তবে অফিসিয়াল কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি।’
সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে প্রায় দুইশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে। এতে জাতীয় গ্রিডের সরবরাহ ছাড়াই এসব ননগ্রিড পাওয়ার দিয়ে শিল্প কারখানা চলছে। লৌহ, সিমেন্ট, গ্লাস, পেপার, টেঙাটাইলের মতো এ ভারী শিল্পগুলোতে ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, পিডিবির বিদ্যুতের চেয়ে গ্যাসনির্ভর ক্যাপটিভ পাওয়ার ব্যয় সাশ্রয়ী এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের নিশ্চয়তা মেলে। তাই শিল্পের জন্য বর্তমানে ক্যাপটিভ পাওয়ারের কোনো বিকল্প নেই। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের কারণে নিরবচ্ছিন্ন সুবিধার কারণে যান্ত্রিক ক্ষতি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার শিল্প কারখানা রক্ষা পাচ্ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্ণফুলী গ্যাসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চট্টগ্রামেও অনেক শিল্প কারখানায় ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্ন নয়। যে কারণে শিল্পোদ্যাক্তারা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধার জন্য ক্যাপটিভ পাওয়ারে ঝুঁকছে। শিল্পের এ বিদ্যুৎপ্লান্টগুলো গ্যাস দিয়েই বেশি চলে। ফলে সরকার শিল্প উৎপাদনের সুবিধার্থে হয়তো সিএনজি স্টেশনগুলোতে রেশনিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘বুধবার থেকে বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়ে শুনেছি। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কোনো চিঠি আমরা এখনো পাইনি। চিঠি পেলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন হবে যেভাবে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনায় আরো ৬ মৃত্যু শনাক্ত ৬৪