মাস তিনেক আগের কথা। এক শুক্রবার সকালে চায়ের মগ হাতে নিয়ে টেলিভিশন খুলে বসি। সমকালীন বিষয় নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছিলেন খ্যাতিমান ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। শুদ্ধ উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গিতে তাঁর কাছাকাছি অবস্থান করার মতো মানুষ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে হাতেগোনা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম, যদিও অনুষ্ঠান তখন শেষ হওয়ার পথে। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি তৈরি ও পালন করা নিয়ে নীতিনির্ধারক ও জনসাধারণের হাস্যকর অথচ ভয়ংকর কর্মকাণ্ড, জনপ্রতিনিধিগণের আলাপের চেয়ে প্রলাপের বলিহারি, অতিমারির দিনে জালিয়াতির মহোৎসব, মানুষের বিপন্নতার সুযোগে কিছু মানুষের ফুলেফেঁপে ওঠার গল্প, সরকারী প্রকল্পের আওতায় নামীদামী ব্যক্তিবর্গের বিদেশ ভ্রমণের কাহিনী- আলোচনার শেষ অংশে এসবই ছিল মূল বিষয়বস্তু। প্রসঙ্গক্রমে তিনি পঞ্চদশ শতকের এক চীনা রাজদূতের (নামটা মনে পড়ছেনা) বঙ্গদেশ ভ্রমণ নিয়ে রচনার একটি উক্তি তুলে ধরেন। চীন দেশীয় সেই মনিষী লিখেছেন- বঙ্গদেশের মানুষ দারুণ সত্যবাদী, তারা কথা দিয়ে কথা রাখে। স্বভাবতই চীনা লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে একালের হালচালের আকাশ পাতাল ব্যবধান নিয়ে ছোট্ট মন্তব্য করেন আলোচক। সেই ছোট্ট মন্তব্যেও অনেক কথা চলে আসে। কথার জাদুকর যে তিনি। মিনিট দশেকের সেই আলোচনায় অধ্যাপক হোসেন যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে নিমিষেই কয়েক পাতা লিখে ফেলা যায়। আর সেসব যদি আমাদের নীতিনির্ধারকগণ ও আমরা জনগণ কানে তুলে কাজে প্রকাশ করে ফেলতে পারি তাহলেতো আর কোন কথাই থাকেনা; আমার প্রাণের বাংলাদেশ নিমিষেই পরিণত হয় স্বর্গরাজ্যে!
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের আলোচনা শেষ হওয়ার পর মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে তাঁর বলা কথাগুলো। এবার ঘরকন্ন্যায় মন দেবার পালা। এমন সময় বেজে ওঠে মুঠোফোন। সুমিষ্ট কণ্ঠের একজন ঘোষক মতো অতি বিনয়ের সঙ্গে একটা চমকপ্রদ খবর জানান; আমারই এক প্রিয় বন্ধুর পূরণ করা এক কুপনের সঙ্গে সংযুক্ত আমার নাম ও ফোন নম্বর র্যাফেল জয়ী হয়েছে। পরিবার নিয়ে তিনরাত্রি দুইদিন বিলাসবহুল পান্থশালায় থাকার দুর্দান্ত এক ‘অফার’। বিশ্বাস করার কোনই কারণ ছিলনা। তাছাড়া বিলাসব্যসনের বিন্দুমাত্র অভিলাষ নেই। দুদিনের জন্যই হোক, আর বিনামূল্যেই হোক। কিন্তু প্রিয় বন্ধুর নামটা কেন বলল? তাই একটু বিভ্রান্তি। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে কিন্নরকণ্ঠীর বয়ানের অসারতার প্রমাণ পাই। পত্রপাঠ না বলে না দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে যে সময়টা নিয়েছি, নিজের বুদ্ধিহীনতার প্রমাণ হিসেবে তাই যথেষ্ট। মৃদু ভৎর্সনা করি নিজেকে; কিছুক্ষণ আগের জ্ঞানগর্ভ আলোচনার শিক্ষা ভুলে গেলাম কেমন করে! এই মুহূর্তে নিশ্চয় অনেকে মুচকি হাসছেন। আর একটু হলেতো ধরাই পড়ছিলাম, জালিয়াতির জালে। তা আপনি হাসতেই পারেন। আমার মেয়ের বাবাও এক প্রস্থ হেসে নিয়েছেন; মেয়ের মায়ের নির্বুদ্ধিতায় কিঞ্চিৎ বিদ্রুপ করার এই সুযোগ তিনিইবা হাতছাড়া করবেন কেন?
আমাদের সমাজটা এখন এমনই। প্রতারিত ব্যক্তি হয় হাসির পাত্র, আর প্রতারক রীতিমত তারকা বনে যায়, ঠিক যেমন পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা মানুষদেরকে নিয়ে হাসাহাসি হয়, অথচ সকল বিধি নিষেধ অমান্য করে নিতান্ত অকারণে ঘুরে বেড়ায় যারা তাদেরকে বীরপুরুষ মনে করা হয়। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এই যে এমন দুঃসহ অতিমারির কালে আমাদের গণমাধ্যমে করোনা নয়, প্রধান চরিত্র এখন প্রতারণা। খবরের কাগজে বড় বড় শিরোনাম ‘সেলিব্রেটি প্রতারক’দের নিয়ে। টেলিভিশনে দিনরাত খবর, ছবি, আর রুদ্ধশ্বাস কাহিনী। মূল ভূমিকায় তারাই। গণমাধ্যমে মুখ দেখানোর সময় তাদের কাউকে একটুও লজ্জিত বা কুণ্ঠিত মনে হয়না। জোর কদমে হেঁটে যান, ঠিক যেমন, “অপরাধীর আস্ফালন দেখে ভয়ে মরে ফরিয়াদি, হত্যাকারী ভীত নয়। প্রাণ হাতে পালিয়ে বেড়ায় নিহতের স্বজন”।
প্রতারণার জাল ও বিষবৃক্ষের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে নানা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্রে। টেলিভিশনের অর্ধশত চ্যানেলে যথারীতি চলছে বিরামহীন টকশো। খবরের কাগজে প্রকাশিত নিবন্ধের কিছু কিছু পড়া হলেও টকশো দেখার সুযোগ হয়না, ইচ্ছেও হয়না। এক শুক্রবার সকালে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের মিনিট দশেকের আলোচনায় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে, সত্যি বলতে কী, এই ক্রান্তিকালে ঐ কথাগুলোই যথেষ্ট আমাদেরকে পথ দেখাতে, জাতিকে রক্ষা করতে। এত এত আলাপ করতে গিয়ে প্রলাপ বকার সময় এখন নেই আমাদের হাতে। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সরকারগুলোর তালিকায় আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান নাকি প্রথম সারিতে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে গচ্ছিত সম্পদের মালিক জনগণ; এর নয়ছয় করার অধিকার জনপ্রতিনিধি, আমলা কারোরই নেই। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, শেষ বিচারের দিন সব কিছুর হিসেব দিতে হবে সবাইকে; একজন মেষপালক তার সকল পোষা প্রাণীর প্রতি সমান আচরণ না করলে তার জন্যও তাকে জবাবদিহি করতে হবে খোদার কাছে। এরপর সঙ্গত কারণে প্রতারণার প্রসঙ্গ আসায় অধ্যাপক হোসেন মন্তব্য করেন, প্রতারণা আমাদের এমনভাবে বেষ্টন করে রেখেছে যে বলতে গেলে কথায় ও কাজে কমবেশি প্রতারণা আমরা সবাই করে ফেলি। আমাদের সমাজে প্রতারণা এখন শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছে, যে কারণে একে আর অপরাধ বলে গণ্য করা হয়না। সবই তাঁর ক্ষোভের কথা। অপরাধ বিবেচিত হল বলেইনা কত সুদর্শন, প্রিয়দর্শিনীর হাতে হাতকড়া পরল!
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে ক’জন প্রতারণা শিল্পী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধৃত হলেন সমপ্রতি, তারাতো রাতারাতি এতদুর আসেনি, একা একাও এতোটা পথ পাড়ি দেয়নি। যার হাত দিয়েই বাংলার বুকে দুর্নীতি ও প্রতারণার বিষবৃক্ষ রোপিত হোক না কেন, দেশ ও জাতির স্বার্থেই সেই বৃক্ষ উপড়ে ফেলা আবশ্যক। কিন্তু শেকড় যে অনেক গভীরে চলে গিয়েছে! শুধু ডালপালা ছেঁটে দিলে কাজ হবে? অধ্যাপক হোসেনের মতো আশাবাদী শিক্ষাবিদগণেরাও তাই আর আশার বাণী শোনাতে পারছেননা। আমাদের দূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস বলে, আমরা অতি দ্রুত জালিয়াতি প্রতারণা সংক্রান্ত শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনীগুলো ভুলে যাব এবং নতুন কোন বিষয় আমাদের গণমাধ্যমে কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে খুব শীঘ্রই, যেমন করে ভুলে গিয়েছি কয়েক মাস আগে বুড়িগঙ্গার পাড়ে স্তূপাকারে রাখা সারি সারি লাশের কথা। নৌকাডুবি, জাহাজডুবি, রানা প্লাজা, তাজরিন ফ্যাশন, চুড়িহাট্টা, ঝিলপাড়, আদমজী- শব্দগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক বেদনার গল্প; শ্রম ঘাম আর রক্তের গল্প। তবে প্রধান ভূমিকায় আছে যথারীতি প্রতারণা, জালিয়াতি- বইয়ের ভাষায় যাকে বলে দুর্নীতি। কারও জানতে বাকী নেই যে, নদীভাঙা আর বানভাসিদের দুর্দশাও কিন্তু নিছক প্রাকৃতিক বালা মুসিবত নয়। রাজধানীর বুকে জল থৈ থৈ, বন্দর নগরীর মহাসড়ক, উড়াল সড়কে জলাবদ্ধতার কথাও না বললে নয়। আমাদের সন্তানদের জন্য বাসযোগ্য রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে প্রতারণার এই সুবর্ণ যুগের অবসান হওয়া বড় প্রয়োজন।