প্রতারণার যত অভিনব ফাঁদ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১১ মার্চ, ২০২৩ at ৪:২৯ পূর্বাহ্ণ

প্রতারণার অভিনব ফাঁদে একের পর এক ধরা পড়ছে মানুষ। ক্ষতিটা শুধু টাকার মানদণ্ডে বিচার্য হলে মানা যেত। কিন্তু কিছু প্রতারণার ঘটনা মুহূর্তেই ধূলিস্যাৎ করে দিচ্ছে সামাজিক মান মর্যাদা থেকে শুরু করে পরিবারের নাম যশ খ্যাতিসহ সবকিছু। নিরুপায় হয়ে আত্মহননের ঘটনাও ঘটছে। নগরীতে এ ধরনের অপরাধের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘটনায় অপরাধীর আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয় অথবা প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করেছে।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেন, আধুনিকতার কিছু কুফল আছে। এ কুফলটা আসার পেছনে আকাশ সংস্কৃতি অনেকাংশে দায়ী। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের পারিবারিক বন্ধনটা ক্রমশ: শিথিল হয়ে যাচ্ছে। যেমন এমএলএম বিজনেস কিংবা খেলা নিয়ে বাজি ধরার কথা যদি বলি তাহলে দেখবো টিনএজ বয়সীরা লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করছে এ খাতে। তারা টাকাটা কোথায় পাচ্ছে? পরিবার থেকেই দিচ্ছে। পরিবারের অটুট বন্ধন কমে যাওয়ায় সন্তানের ওপর থেকে মাবাবার নিয়ন্ত্রণও চলে যাচ্ছে। এ প্রবণতা রোধ করতে সামাজিক

সচেতনতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, মাবাবার সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঠেকাতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

বিশ্বাসের মূল্য ফেরত আত্মসাতে : গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ভাগ্নির ব্যাংক হিসাবের সই জাল করে শেয়ার স্থানান্তরের মাধ্যমে ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিইসির মোড় থেকে মামা ছালেহ মুহাম্মদ আবু ফয়েজকে (৫০) গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) আলী হোসেন বলেন, ভাগ্নি বিদেশ থাকার সুবাদে আসামি নিজের মোবাইল নম্বর ও ইমেইল অ্যাড্রেস ব্যবহার করে ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শেয়ার স্থানান্তরের মাধ্যমে টাকা আত্মসাত করে। শুধু টাকা আত্মসাত নয়, লংঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজ থেকে ভাগ্নির নামে ঋণও উত্তোলন করেন মামা।

১২ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ পরিশোধ না করার অভিযোগে ছয় মামলার সাজাপ্রাপ্ত দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদুল কবির বলেন, শিবুপদ সিকদার ও তার স্ত্রী আন্না সিকদার ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক হতে ঋণ নিয়ে ঋণের অর্থ পরিশোধ না করে আত্মগোপনে চলে যায়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত ২০২২ সালে তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। আসামিরা সাজার মেয়াদ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য আত্মগোপনে চলে যায়। গ্রেপ্তারের পর

তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

গত ৭ জানুয়ারি অর্থ আত্মসাতের আরেকটি কৌশল উন্মোচিত হয়েছে মহানগর গোয়েন্দা (বন্দর ও পশ্চিম) বিভাগের অভিযানে। উপপুলিশ কমিশনার (ডিবিবন্দর ও পশ্চিম) মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকাচট্টগ্রামের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের হোটেলে অবস্থান করে নিজেদেরকে তেল ও চিনির আমদানিকারক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। পরে তাদের সহযোগীদের সাথে নিয়ে তেল ও চিনি বিক্রির কথা বলে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের থেকে লাখ লাখ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিত।

মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভেজালকারীরা : মাস দেড়েক পরেই শুরু হচ্ছে রোজা। সেহরিতে দুধঘিয়ে ভাত কিংবা রকমারি ইফতারি তৈরিতে আলাদা কদর ঘিয়ের। রোজার বাজার ধরতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভেজাল ঘি ব্যবসায়ীরা। পোড়া তেল আর পামঅয়েল মিশিয়ে জাল দেয়ার পর ঘিয়ের ফ্লেভার মিশিয়ে রাতভর ভরা হচ্ছে সব নামিদামি ব্র্যান্ডের কৌটায়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অভিযান টিম বিসিক শিল্পনগর এলাকায় কমোডিটিস নামের একটি কারখানায় হানা দিয়ে দেখতে পায় সেখানে তৈরি হচ্ছে ১০ ধরনের ভেজাল ঘি। ১৪ ফেব্রুয়ারি অবৈধ উপায়ে দুধ

মোড়কজাতকরণ এবং খোলা গুঁড়া দুধ এনে ডানো ও স্যামা মিল্কের নামে বাজারজাত করার অপরাধে উত্তর কাট্টলী এলাকায় সিটি গেটের পাশে এনজিএস ফুড প্রোডাক্টসকে জরিমানা করা হয়।

৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর বায়েজিদে ‘জেবি কেয়ার বাংলাদেশ’ নামে একটি ভেজাল প্রসাধনীর কারখানায় অভিযান চালিয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত। তিনি বলেন, অভিযানে বিপুল পরিমাণ অনুমোদনহীন সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, গ্লিসারিন, ফেসওয়াস, সেঙুয়াল ট্যাবলেট, ব্রেস্ট ক্রিম, ব্যথানাশক ক্রিমসহ বিভিন্ন ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রী জব্দ করা হয়।

প্রতারণার অন্যতম অস্ত্র জাল নোট : গত ১ মার্চ চট্টগ্রামকঙবাজার মহাসড়কে চট্টগ্রামগামী যাত্রীবাহী হানিফ বাস থেকে ২০ লাখ টাকার জাল নোটসহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লোহাগাড়ার চুনতি রেঞ্জ বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, কঙবাজারে অবস্থানকারী তাদের একজন সহযোগী জাল নোটগুলো বিনিময়ের জন্য সরবরাহ করেছিল।

অলৌকিক না লৌকিক : রফিকুল ইসলাম ওরফে তারা মিয়া (৫৫) পড়েছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু এইচএসসির ক্যামেস্ট্রির (রসায়ন) বই পড়ে রপ্ত করেছেন কোন রাসায়নিকের সঙ্গে কোন রাসায়নিক মিশ্রণ করলে কি হবে! রপ্ত করা জ্ঞান থেকে বানিয়েছেন ‘অলৌকিক কয়েন’। যার মধ্যে চিনি রাখলে তা গলে যায়। সাধারণ মানুষকে সেই ‘অলৌকিক কয়েন’ গলিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে প্রথমে বোকা বানায় তারপর বাড়তি দামে বিক্রি করার লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় লাখ টাকা। এমন চক্রের মূলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

অল্প টাকায় বেশি মুনাফা : অল্প টাকায় বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে অগ্রিম টাকা হাতিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেত হাসিব নামের এক প্রতারক। তার বাবামাও এই প্রতারণা ধান্দার সঙ্গে জড়িত। গত বছরের ৯ অক্টোবর মো. মাসুদ রানা নামে এক ব্যবসায়ী তাদের এই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পাইকারিতে সিগারেট বিক্রির নামে ৩৭ লাখ টাকা খোয়ান। এরপর তিনি মামলা করলে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।

প্রহসনের প্রেম : ফেসবুকে ৪ বছর প্রেম করার পর কলকাতার কলেজ ছাত্রী চট্টগ্রামে এসে ‘প্রতারণা’র শিকার হয়েছেন। প্রায় দুই মাস চট্টগ্রামে থাকার পর ওই ছাত্রী ‘ভুল বুঝতে পেরে’ ভারতে ফিরে গেছেন। কলকাতার রানাঘাট এলাকার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু কলেজের ওই ছাত্রী গত ৩ ডিসেম্বর ভোমরা বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন। উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামের অলংকার মোড় এলাকার ‘ফেসবুক বন্ধু’ সাইফুল খানের সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু সাইফুল দেখা করেনি।

সনদ জালিয়াতি : ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ সহ মোট ছয়টি সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন জেলার জন্ম নিবন্ধনের সার্ভার হ্যাক করে ভুয়া জন্ম সনদ তৈরির ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আসিফ মহিউদ্দীন

জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা জালিয়াতি করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন, ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনসহ, ফরিদপুর, বাগেরহাট ও নরসিংদী জেলায় অসংখ্য জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে। যা যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম, নড়াইল, ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জে টানা অভিযান চালিয়ে পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২৬ জানুয়ারি বিকেলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট চসিক জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতি চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে গত ২৪ জানুয়ারি একই ঘটনায় গ্রেপ্তার করে চারজনকে।

চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা : দেশে যে হারে বেকারত্ব বাড়ছে, সে হারে বাড়ছে না চাকরির সুযোগ। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে কিছু প্রতারক চক্র। আকর্ষণীয় বেতন, ভাতাসহ নানা সুযোগসুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে চাকরি দেয়ার নামে বেকার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে নগদ টাকা। পাশাপাশি নানাভাবে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।

পাপড়ি নামে এক তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডি ইন্টেলিজেন্স টিম কিছুদিন এনালাইসিস করে প্রতারক আতিকুর ওরফে আজিজুল ইসলামকে (৩০) গত ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে। সিআইডির সাইবার ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, মূলত অনলাইনে প্রতারণাই আজিজুলের পেশা। ২০১৮ সাল থেকে এ ধরনের কাজ করে আসছে। অন্তত ৫০ জন নারীপুরুষের সাথে এ ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে স্বীকার করেছে সে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহানগর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ আজ
পরবর্তী নিবন্ধএবার ভোট দেখতে চায় ২১০ প্রতিষ্ঠান