প্রজন্মগত ব্যবধান : অভিভাবকের প্রত্যাশা বনাম সন্তানের স্বপ্ন

ফারহানা পপি | সোমবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:২০ পূর্বাহ্ণ

সময়ের সাথে সাথে প্রজন্ম বদলায়, বদলায় তাদের স্বপ্ন, লক্ষ্য আর চিন্তাধারা। এই পরিবর্তনের স্রোতে বাবামা ও সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে তৈরি হচ্ছে গভীর ব্যবধান। একদিকে বাবামা চান সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত পেশায় নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুক; অন্যদিকে সন্তানরা চায় নিজেদের স্বপ্ন, স্বাধীনতা ও নতুন প্রজন্মের জীবনধারাকে অনুসরণ করতে। এই মতপার্থক্য পরিবারে তৈরি করছে মানসিক চাপ, ভুল বোঝাবুঝি ও সম্পর্কের টানাপোড়েন।

গবেষণা প্রতিবেদন কী বলছে

সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্র যৌথভাবে ‘অভিভাবক ও কিশোরকিশোরীদের প্রত্যাশা’ বিষয়ক একটি গবেষণা কার্র্যক্রম পরিচালনা করেছেন, যা journal of Adolescence এ প্রকাশিত হয়েছে।

উক্ত গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কিশোরকিশোরীরা ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও স্বাধীনতাকে (যেমনআত্মউপলদ্ধি, শখ, বন্ধুদের সাথে সংযোগ) অগ্রাধিকার দেয়। অপরদিকে বাবামা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাস্তববাদী: তারা শিক্ষা, বিয়ে ও আর্থিক নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। এখান থেকেই বোঝা যায়, বাবামায়ের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তববাদী ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক। আর সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গী স্বাধীনতাকেন্দ্রিক ও আত্মপ্রকাশমুখী। সন্তানের স্বপ্ন হয়তো ছোট, কিন্তু তা আন্তরিক ও আনন্দমুখী। বাবামায়ের প্রত্যাশা বড়ো, কিন্তু তা নিরাপত্তা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। এখানেই তৈরি হয় প্রজন্মগত ব্যবধানের আসল চিত্র।

এই গবেষণার ফলাফল আমাদের বুঝিয়ে দেয় কেন পরিবারে প্রজন্মগত ব্যবধান এতো প্রকট। এই ব্যবধান কেবল বাংলাদেশে নয়, গোটা পৃথিবীজুড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেখা যায়। আধুনিক প্রযুক্তি, সামাজিক পরিবর্র্তন ও দ্রুতগতির বিশ্বায়ন এই ব্যবধানকে আরও গভীর করেছে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রাসঙ্গিকতা

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাঝি কবিতার শিশুটি মাকে বলেছিল– ‘মা যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি।’ কবিতার শিশুটি বড়ো হয়ে মাঝি হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছেযা মূলত স্বাধীনতা, প্রকৃতির সান্নিধ্য ও নিজের স্বপ্নের অনুসন্ধানের প্রতীক।

প্রজন্মগত ব্যবধানের প্রভাব

সন্তান মনে করে বাবামা তার স্বপ্নকে বোঝে না, যার ফলে পারিবারিক সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা যায়। অভিভাবকদের পরামর্শকে কিশোর বয়সে কেউ কেউ মানসিক চাপ হিসেবে নেয়, যা তাদের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব তৈরি করে। আবার অনেক সৃজনশীল তরুণ তরুণী বাবামায়ের প্রদর্শিত পথে চলতে গিয়ে নিজস্ব প্রতিভা বিকশিত করতে পারে না। প্রজন্মের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব সমাজে বিভক্তি ও মূল্যবোধের সংঘাত তৈরি করে। সন্তানরা যখন পরিবারের দিকনির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজস্ব মতের পক্ষে ছুটে যায়, তখন তারা প্রায় সময়ই ভুল সিদ্ধান্তের ফাঁদে পড়েযার পরিণতি দুঃখজনকভাবে পরিবার ও সমাজকেই ভোগ করতে হয়।

ব্যবধান কমানোর উপায় ও সুপারিশ

. পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানো

সবচেয়ে জরুরি হলো বাবা মা ও সন্তানের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা। সন্তানরা কী ভাবছে, কী স্বপ্ন দেখছে তা বাবা মায়ের শোনা উচিত। আবার সন্তানদেরকেও বাবা মায়ের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে হবে।

. স্বপ্ন ও বাস্তবতার মেলবন্ধন

সন্তানের একান্ত স্বপ্নের যৌক্তিকতা অনুযায়ী বাবা মা সেটির বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে দিতে পারেন।

. প্রযুক্তি ও সময়ের সাথে খাপ খাওয়ানো

আজকের সন্তানরা ডিজিটাল জগতে বেড়ে উঠছে। বাবা মায়ের উচিত সন্তানের প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখে এর ইতিবাচক দিক খুঁজে বের করা এবং সন্তানদের সেই অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ দেখানো।

. শিক্ষা ও পেশা নির্বাচনে নমনীয়তা

অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের আগ্রহের প্রতি সম্মান দেখানো। একইসঙ্গে সন্তানদেরও বুঝতে হবে বাবা মায়ের অভিজ্ঞতার মূল্য আছে। দুই দিক থেকে আপস করে একটি সুষম সমাধান বের করা দরকার।

. মানসিক স্বাস্থ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক

প্রজন্মগত ব্যবধান দূর করতে পরিবারের পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ করতে হবে। যাতে সন্তানরা যে কোনো সমস্যায় বাবা মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে।

. যৌথ কার্যক্রম

পরিবারে একত্রে সময় কাটানোযেমন ভ্রমণ, খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় অনুশীলন ইত্যাদি কার্যক্রম বাবা মা ও সন্তানের সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করে।

. সামাজিক সচেতনতা

স্কুলকলেজ, সামাজিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে বাবা মা ও সন্তানের মধ্যে বোঝাপড়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কর্মশালা, সেমিনার, আলোচনা সভা এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।

প্রজন্মগত ব্যবধান একটি স্বাভাবিক বিষয়। সময়, পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার ভিন্নতায় প্রত্যেক প্রজন্মের জীবনদর্শন ভিন্ন হয়। তবে এই ভিন্নতা যেন সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি না করে সেটাই চ্যালেঞ্জ। বাবামা ও সন্তানের মধ্যে যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, খোলামেলা আলোচনা এবং সহনশীলতা বজায় থাকে; তবে এই ব্যবধান সহজেই কমে আসবে। প্রজন্মগত ব্যবধানকে বিরোধ নয়, বরং অভিজ্ঞতা ও নতুনত্বের সংমিশ্রন হিসেবে দেখা উচিত। কারণ বাবামায়ের অভিজ্ঞতা এবং সন্তানের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে মিলে যদি জীবন গঠন করে, তবে সেটিই হবে একটি সুন্দর পরিবার ও শক্তিশালী সমাজ গড়ার হাতিয়ার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্ণফুলীতে এনসিপির উঠান বৈঠক
পরবর্তী নিবন্ধলাভ দিয়াজের দীর্ঘ আখ্যান: ভয় আর সংগ্রামের এক দশক