পঞ্চবার্ষিকী কর পুনমূল্যায়ন (রি-অ্যাসেসমেন্ট) কার্যক্রম শুরু করতে চায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর অংশ হিসেবে গত ৩ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে দুটো প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- পঞ্চবার্ষিকী কর পুনমূল্যায়নে ২০১৭ সালের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কর আদায়। অথবা স্থগিতকৃত পুনর্মূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করা।
ভবন মালিকদের শঙ্কা, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে সেই ‘অতিরিক্ত’ কর পরিশোধ করতে হবে তাদের। এছাড়া চলমান করোনা পরিস্থিতিতে নানা কারণে আর্থিক সক্ষমতা কমেছে তাদের। এ অবস্থায় পৌরকরের হার বাড়লে তা হবে আরো অসহনীয়। চসিকের রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ এবং করদাতাদের শঙ্কা নিয়ে দৈনিক আজাদীর কথা হয় চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী এবং চসিকের সাবেক কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট এম এ নাছেরের সঙ্গে।
মাহবুবুল আলম
গৃহকর যেভাবে আছে সেটাই বহাল থাকুক
করোনা পরিস্থিতিতে গৃহকর বাড়ে এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত হবে না বলে মনে করেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি আজাদীকে বলেন, মেয়র সাহেব তো কয়েক দিন আগেও বলেছেন, গৃহকর বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নাই। আমরা মনে করি, করোনাকালীন গৃহকর যেভাবে আছে সেটাই বহাল থাকুক।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ঘর ভাড়াও কমে গেছে। অনেক জায়গায় ভাড়াটিয়াও নাই। মানুষ ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। ভবন মালিক যারা ঘর ভাড়ার আয়ের উপর নির্ভরশীল তাদের অবস্থাও নাজুক। করোনায় মানুষের আয় কমে গেছে। অনেক চাকরিজীবীর চাকরি নাই। কাজেই বিদ্যমান গৃহকর বহাল রাখা উচিত।
তিনি বলেন, যেহেতু মন্ত্রণালয় স্থগিত করেছে। সেটা নিয়ে আবার নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করা ঠিক হবে না। কর্পোরেশন অন্যভাবে আয় বাড়াতে পারে। সরকার থেকে থোক বরাদ্দ আনার চেষ্টা করতে পারে। সরকার থেকে সহযোগিতা নিয়ে শহরের উন্নয়নে কাজ করতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গৃহকর বাড়ানো ঠিক হবে না।
আখতার কবির চৌধুরী
করোনায় মানুষকে স্বস্তি দিন
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে গৃহকরের নামে মানুষকে হয়রানি না করার জন্য সিটি মেয়রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। তিনি আজাদীকে বলেন, করোনায় মানুষ কাজ হারিয়েছে। দুর্নীতিবাজরা ছাড়া অন্যরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। সেই জায়গায় ট্যাঙের নামে নতুন করে হনুমানের লেজে আগুন দেওয়ার অর্থ হতে পারে না। কেন করবে এসব? সিটি কর্পোরেশন আমাদের কি সেবা দিয়েছে?
তিনি বলেন, আইনে আছে, মহামারী হলে বাধ্যতামূলক সেবা দিতে হবে। তারা কি সেবা দিয়েছে? পরে নামকা ওয়াস্তে আইসোলেশন সেন্টার করেছে। কিন্তু সেখানে অনেক অনিয়মের কথা আছে। একশ জনকে সেবা দিয়ে ১০ হাজার জনের বেশি টাকা খরচ করে ফেলেছে। তাই আমরা বলবো, নতুন করে যেন মানুষকে আর হয়রানি করা না হয়। পৌরকর যেভাবে আছে সেভাবে থাক। বরং মানুষের কষ্ট লাঘবে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাশা করবো, মানুষকে ট্যাঙের নামে যেন হয়রানি করা না হয়। এখন যদি করা হয় তা হবে মরার উপর খাড়ার ঘা। নাগরিকদের যেন করোনায় রাস্তায় নামতে না হয়। সিটি কর্পোরেশনের উচিত নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের স্বস্তির ব্যবস্থা করেন।
তিনি আরো বলেন, শহরে নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে বড় সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি থেকে মানুষ নানা সেবা ও সুবিধা পাবে বলে প্রত্যাশা করে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের নৈমিত্তিক কাজ তথা পরিচ্ছন্নতা, আলোকায়ন, মশক নিধন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত কখনো কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছেনি। কোনো কোনো মেয়রের সময়ে হয়তো কিছুটা সাফল্য ছিল। কিন্তু যে শূন্য, সেই তিমিরই এখন বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন দুর্নীতির প্রধান আখড়া। অ্যাসেসমেন্ট কাজ করা মানে মানুষকে আবার নতুন করে হয়রানি করা থেকে শুরু করে দুর্নীতি আকাশচুম্বি হবে। তারা ট্যাঙ নিবে ঠিক আছে, কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা যেটা দেওয়ার সেটা একেবারেও দিচ্ছে না। এখানকার অভ্যন্তরীণ যে দুর্নীতি, তা গতবারও শুনেছি। ইচ্ছে মত হরিলুট হয়। যারা রাজস্ব বিভাগে দায়িত্বে আছেন তাদের স্বচ্ছতা, সততা নিশ্চিত হওয়া ছাড়া অ্যাসেসমেন্ট করার অর্থ হবে, বিড়ালকে মাছ কাটতে দেয়া। তেমন হলে নাগরিকদের কি অবস্থা হবে।
অ্যাডভোকেট এম এ নাছের
স্থগিতাদেশ বহাল থাকুক
বর্তমান প্রেক্ষাপটে গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের স্থগিতাদেশ বহাল রাখা উচিত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট এম এ নাছের। তিনি আজাদীকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। এরপরও লোকজনকে পৌরকর পরিশোধ করতে হবে। সেক্ষত্রে ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে থাকা বাঞ্ছনীয়। সাধ্যের মধ্যে থাকলে নগরবাসী পরিশোধ করবে। কিন্তু অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দিলে মানুষ আপত্তি করবে, মামলা করবে পরিশোধ করতে চাইবে না। তাই জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের বেশি কড়াকড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, ভবন মালিক হলেই যে সবাই সক্ষম তা না। যেমন নারায়ণগঞ্জের একজন ভবন মালিক আর্থিক অক্ষমতার কারণে ত্রাণ চেয়েছেন। সেটাই বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান প্রেক্ষাপট। আমাদের এলাকায় অনেকেই আমাকে বলেছেন, ‘ঘর আছে। কিন্তু চলতে পারি না, ওষুধ খেতে পারছি না। নিত্য চাহিদা পূরণ করতে পারছি না’। অর্থাৎ ঘর থাকলেই অনেকেই সচ্ছল তা না।
গৃহকর পুনর্মূল্যায়নে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে মন্ত্রণালয়ে সিটি কর্পোরেশনের চিঠি দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-২ এর এপিপি বলেন, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে আমাদের আপত্তি থাকবে। ওই সময় সরকার জনগণের অসুবিধার বিষয়টি অনুধাবন করেছে বলেই স্থগিত করেছিল। কারণ ওই অ্যাসেসমেন্টে গৃহকর ১০-১২ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। আমরা চাইব, স্থগিতটা বহাল থাকুক। প্রয়োজনে মেয়র নাগরিকদের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে যোগ্যতা অনুসারে ট্যাক্স নির্ধারণ করুক। কিন্তু এক লাখ টাকার অ্যাসেসমেন্ট ১০ লাখ টাকা হলে কিভাবে দিবে? যেটা গতবার হয়েছিল। ট্যাক্স বাড়লে ঘর ভাড়াও বাড়বে।
তিনি বলেন, মেয়রকে আমরা বলবো, পৌরকর নির্ধারণে অন্তত মহিউদ্দিন ভাইকে (প্রয়াত সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী) যেন অনুসরণ করেন। অর্থাৎ ট্যাক্সের হার বাড়াবেন না, কিন্তু নতুন যেসব বাড়ি হবে তাদের করের আওতায় আনবেন। যেমন কোনো দোতলা ভবনকে তিন তলা করা হলো। তিন তলা হওয়ার আগ পর্যন্ত ভবনটির দুই তলা ট্যাক্সের আওতায় ছিল। এখন আরেক তলাকেও ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে। নির্বাচনের আগেও তিনি এ ধরনের কথা বলেছিলেন, নতুন ভবন বা ভবনের বর্ধিত অংশকে করের আওতায় আনা হবে। তেমন হলে তা যৌক্তি