পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নের (রি-এসেসমেন্ট) আলোকে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পৌরকর আদায়ের উদ্যোগ নিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর অংশ হিসেবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে দুটো প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে-পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কর আদায়। অথবা স্থগিতকৃত পুনর্মূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে এসেসমেন্ট করা। এর আগে করদাতাদের আপত্তির মুখে ২০১৭ সালে রি-এসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল মন্ত্রণালয়। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া রি-এসেসমেন্ট এর আলোকে পৌরকর আদায়ে প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে ২৫ অক্টোবর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারও করে নেয় মন্ত্রণালয়। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পূর্বের স্থগিতাদেশ বহাল থাকায় সাধারণ ভবন মালিকরা রক্ষা পায় ‘অতিরিক্ত’ করের বোঝা থেকে। এখন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে চাপে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
নগরবাসী বলছেন, ইতোমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাই বেসরকারিতে বাতিল করবে বলে মনে হয় না। যদি ব্যক্তি মালিকানায়ও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয় তখন সেই বাড়তি কর পরিশোধ করতে হবে। আবার বাতিল করলেও সমস্যা তৈরি হবে। তখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আপত্তি জানাবে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পৌরকর নির্ধারণে গত মাসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে (ডিএনসিসি) রি-এসেসমেন্ট করার অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর চট্টগামেও কার্যক্রম শুরু করতে তৎপর হয় চসিক। এরপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, যে পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত হয়েছে তার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার অথবা নতুন করে এসেসমেন্ট করার অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে নতুন করে এসেসমেন্ট করার যে অনুমতি দেয়া হয়েছে সেটাকে রেফারেন্স হিসেবে আমরা উল্লেখ করেছি। পুনর্মূল্যায়িত কর বাতিল করলে আইনগত কোনো জটিলতা আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, সমস্যা হবে না।
চসিকের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা গেছে, চসিকের নিজস্ব আয়ের মূল উৎস পৌরকর। সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই চসিক মোট ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর), ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আর্বজনা অপসারণ রেইট রয়েছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশান রুলস অ্যাক্ট ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে পৌরকর নির্ধারণ করা হয়। আইনটির আলোকে ২০১৬ সালে গৃহ ও ভূমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন করে চসিক। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ প্রথম দফায় নগরের ১১টি ওয়ার্ডে এসেসমেন্ট শুরু করে এবং একই বছরের ২০ জুন শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১৮ অক্টোবর বাকি ৩০টি ওয়ার্ডে এসেসমেন্ট শুরু করে এবং তা শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি। পুনর্মূল্যায়ন শেষে তা ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। এতে নগরের ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮টি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা পৌরকর আদায়ের প্রস্তাব করে চসিক। যা পূর্বের অর্থ বছরে ছিল ১০৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৭ টাকা। এদিকে জনসম্মুখে চসিকের এসেসমেন্টর বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর প্রস্তাবিত পৌরকরের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান ভবন মালিকরা। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা মাঠে নামেন। এক্ষেত্রে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করেন। প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরীও এর বিরোধিতা করেন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর গৃহকর বৃদ্ধি করায় জাতীয় সংসদেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী-এমপিরা। পরবর্তীতে ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ কমর্তকর্তারা। এতে সারা দেশের গৃহকর কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় না আসা পর্যন্ত এসেসমেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়। যা ১০ ডিসেম্বর চসিককে পত্র দিয়ে জানিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়। অবশ্য এর আগে মৌখিক নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর থেকে এসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল চসিক। স্থগিতের আগের দিন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৩৫২ জন হোল্ডার আপিল করেন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৭৮ টি আপিল নিষ্পত্তিও করা হয়ছিল।
এর দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পর নতুন করে এসেসমেন্ট কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি আজাদীকে বলেন, আগে এক তলা ছিল এমন অনেক ভবন চার-পাঁচ তলা হয়ে গেছে। তারা তো দীর্ঘদিন ধরে ট্যাক্স দিচ্ছে না। এভাবে চললে তো হবে না। তাই আমরা পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নিচ্ছি। এ বিষয়ে দুটো প্রস্তাব আমাদের। এখন মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেয় সে আলোকে বাস্তবায়ন করব।
চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমি দৈনিক আজাদীকে বলেন, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে চট্টগ্রামবাসী মেনে নিবে না। তারা আবার আন্দোলন করবে। তিনি বলেন, নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করতে গেলে পূর্বের সমস্যাটি সামনে আসবে। কারণ বর্গফুটের পরিবর্তে ভাড়ার ভিত্তিতে কর নির্ধারণ করায় আমরা আপত্তি করেছিলাম। এখন পুনর্মূল্যায়ন করতে গেলেও আইনের কথা বলে চসিকে আবারো ভাড়ার বিপরীতে আদায় করতে চাইবে। এতে সমস্যার সমাধান হবে না। কাজেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার বা বাতিলের চেয়ে আইনটি সহজ করা উচিত। তাই আমরা আইনটি বাতিল চাই।
উল্লেখ, পূর্বে ভবনের মূল্যায়ন করা হত বর্গফুটের ভিত্তিতে। কিন্তু ২০১৬-২০১৭ সালে করা হয় ভবনের ভাড়া বা আয়ের বিপরীতে। সেখানেই আপত্তি ছিল করদাতাদের।












