পৃথিবী এখন কেমন আছে

অতীতেও কি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল

| শনিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী বড় ধরনের এক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু পৃথিবী যে উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে তার পক্ষে কী ধরনের তথ্যপ্রমাণ আছে এবং আমরা কীভাবে জানি যে মানুষই এর জন্য দায়ী?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিল্প যুগের প্রাক-মুহূর্ত থেকে আমাদের এই গ্রহ দ্রুত উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ১৮৫০ সালের পর থেকে পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে গত চার দশকের প্রত্যেক দশকে তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত লাখ লাখ তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন। খবর বিবিসি বাংলার।
স্থলভূমিতে আবহাওয়া কেন্দ্র, সমুদ্রে জাহাজ এবং আকাশে স্যাটেলাইটের সাহায্যে এসব তাপমাত্রা মাপা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের নিরপেক্ষ বহু দল একই ফলাফল পেয়েছেন, শিল্পযুগের প্রারম্ভ থেকে এই তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। অতীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা কীভাবে ওঠানামা করেছে বিজ্ঞানীরা সেটাও খুঁজে বের করতে পারেন। গাছের কাণ্ড, বরফের স্তর, হ্রদের তলানিতে জমা পলি এবং প্রবাল এসব অতীতে জলবায়ু কেমন ছিল তার সাক্ষ্য বহন করছে। বর্তমানে যে হারে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এসব থেকে তার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বলছেন, সোয়া এক লাখ বছরের মধ্যে পৃথিবী এত উত্তপ্ত আর কখনো ছিল না। পৃথিবীতে সূর্যের তাপ আটকে রাখে গ্রিনহাউজ গ্যাস। মানুষের কর্মকাণ্ড থেকে এসব গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এসব গ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড। কারণ বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। বলা যায়, কার্বন ডাইঅক্সাইডই সূর্যের তাপকে পৃথিবীতে আটকে রাখে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং গাছপালা কেটে ফেলার কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীর পর থেকে এই দুটো কর্মকাণ্ডই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅঙাইডের পরিমাণ এই সময়কালের মধ্যে বেড়েছে।
অতিরিক্ত এই কার্বন ডাইঅঙাইড কোত্থেকে এসেছে সেটা সুনির্দিষ্টভাবে দেখানোর একটি উপায় আছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে যে কার্বন উৎপাদিত হয় তার একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গাছের কাণ্ড এবং মেরু অঞ্চলের বরফ এই দুটোই বায়ুমণ্ডলে রাসায়নিক পরিবর্তনের রেকর্ড বহন করে। এসব পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ১৮৫০ সালের পর থেকে, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে, কার্বনের নির্গমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গেছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আট লক্ষ বছর ধরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅঙাইডের পরিমাণ ১০ লাখে ৩০০ পার্টসের বেশি (পার্টস পার মিলিয়ন বা পিপিএম) বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর কার্বন ডাইঅঙাইডের পরিমাণ বেড়ে বর্তমান মাত্রায় এসে দাঁড়িয়ে, যা ৪২০ পিপিএম।
কম্পিউটার সিমুলেশন, যা জলবায়ু মডেল হিসেবে পরিচিত, ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে, মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে যদি ব্যাপক হারে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন না ঘটত তাহলে তাপমাত্রার কী হতো। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ রকম হলে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে তাপমাত্রা খুব সামান্যই বৃদ্ধি পেত। কিছু ঠাণ্ডা হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। এ রকম হতো যদি শুধু প্রাকৃতিক কারণগুলোই জলবায়ুর ওপর প্রভাব রাখত। কিন্তু যখন মানুষের কারণগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলো, জলবায়ু মডেলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা গেল।
গত ৫০ বছরে আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের ঘটনা পাঁচ গুণ বেড়েছে। এই গ্রহের ওপর মানুষ কী ধরনের প্রভাব ফেলছে? পৃথিবী ইতোমধ্যে যে মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে তার ফলে আমাদের চারপাশে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাস্তব পৃথিবীতে যে ধরনের পরিবর্তন ঘটছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন তার মধ্যে রয়েছে : ১. গ্রিনল্যান্ড এবং এন্টার্কটিকায় বরফের স্তর দ্রুত গলে যাওয়া। ২. গত ৫০ বছরে আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের সংখ্যা পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পাওয়া। ৩. গত শতাব্দীতে সারা বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ সেমি (৮ ইঞ্চি) বেড়ে গেছে এবং এখনও বেড়েই চলেছে। ৪. ১৮০০ সালের পর থেকে সমুদ্রে অ্যাসিডের মাত্রা ৪০% বেড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে সামুদ্রিক জীবনের ওপর।
পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কয়েকবার সময় এসেছে যখন এই গ্রহটি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। নয় কোটি ২০ লাখ বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা এত বেশি ছিল যে, মেরু অঞ্চলে বড় আকারের বরফের খণ্ড ছিল না। কানাডিয়ান আর্কটিকের মতো উত্তরাঞ্চলে কুমিরের মতো কোনো প্রাণীরও অস্তিত্ব ছিল না। তবে তখনও মানুষের আবির্ভাব ঘটেনি। এছাড়া অতীতে কখনও কখনও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের চেয়ে ২৫ মিটার (৮০ফুট) উঁচু ছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৬ থেকে ২৬ ফুট বৃদ্ধি পেলে পৃথিবীর বেশিরভাগ উপকূলীয় শহর পানির নিচে তলিয়ে যাবে। অতীতের যে সময়গুলোতে তাপমাত্রা বেশি ছিল তখন গণহারে পশুপাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রচুর তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।
জলবায়ু মডেল বলছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় কখনও কখনও তাপমাত্রা এত বেশি ছিল যে বেশিরভাগ পশুপাখির জন্যেই সেরকম উত্তপ্ত পরিবেশে বেঁচে থাকা খুব কঠিন ছিল। নানা কারণেই এই তাপমাত্রা ঠাণ্ডা ও গরমের মধ্যে ওঠানামা করেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসবের মধ্যে রয়েছে সূর্যের চারপাশে দীর্ঘ সময় ধরে প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর এপাশে ওপাশে নড়ে ওঠা, আগ্নেয়গিরির অগ্নুপাত এবং এল নিনোর মতো জলবায়ু চক্র।
তবে বহু বছর ধরে একদল মানুষ আছেন বায়ুুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে ওঠার এসব বৈজ্ঞানিক কারণের বিষয়ে যাদের সন্দেহ রয়েছে। তবে সকল বিজ্ঞানী, যারা বিভিন্ন জার্নালে নিয়মিত তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকেন, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান কারণগুলোর বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। এ বছর জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানুষের প্রভাবের কারণে বায়ুমণ্ডল, সমুদ্র এবং ভূমি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্ভাবনা যখন কাউনে লামা ও আলীকদম
পরবর্তী নিবন্ধবি ইউনিটে পাসের হার ২৮. ৮২ শতাংশ