পূরবী সন্ধ্যা

কুমুদিনী কলি | শুক্রবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ

শেষবিকেলের সোনারোদ তখনো আকাশের গায়ে ঝলমল করিতেছে। সূর্যাস্ত আগতপ্রায়! সোনারঙা রোদ্দুর আর সম্মুখে মৃতপ্রায় একস্রোতা ছোট্টো নদী। কী অপরূপ, অপার্থিব, মনোরম ঘনায়মান এক সোনাঝরা সন্ধ্যা! নদীর অপর পাড়ে পাহাড়ি আদিবাসীদের কর্মব্যস্ত দিনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলিতেছে। তাহাদের মুখনিঃসৃত ভাষার কিছু বুঝিতে না পারিলেও বেশ উপভোগ্য মনে হইতেছে পুরো পরিবেশটাই। নদীর মাঝবরাবর এক বিশালাকার লম্বা কিছু সাঁই করিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেলো। সাপ বলিয়া মনে হইলো। তাহাতেও ভালো লাগিতেছে।

জানি না কেনো, অন্তরে ভয়ের উপদ্রব হইলো না। মনে হইতেছে, এই নির্জনে, অচেনা পরিবেশে, পাখিদের আর আদিবাসীদের দুর্বোধ্য ভাষার কলতানে পৃথিবীতে এক অদ্ভুত, অনির্বচনীয় শান্তি নামিয়া আসিয়াছে। তাহাতে মনের অসুখ সারে, তাহাতে চোখের সুখ হয়, তাহাতে রিপুর চঞ্চলতা কমিয়া আসে। নিজেকে নতুন করিয়া চিনিতে পারা যায়।

হয়তোবা নদীতে এখন কোমর অবধি জল থাকিবে। শুকনো মৌসুমে তাহার দেহ অতিশয় কৃশকায় হইয়া ওঠে। আবার ভরা বর্ষায় তাহার জীর্ণ শীর্ণ দেহ ফুলিয়া, ফাঁপিয়া অতিশয় বলবান, ভয়ংকরী হইয়া ওঠে। তখন তাহাকে আর চিনিতে পারা যায় না। দুইকূলের সমস্ত খেত, বাড়িঘর তখন তাহার ক্ষুধাতুর মুখের গ্রাসে পরিণত হইয়া নিঃশেষ হইয়া যায়। আর তাহাই এই দুইপাড়ের আদিবাসীদের পরম দুঃখ। অনিশ্চিত জীবনযাত্রার ভয়ংকরতম দিনগুলোতে তাহাদের আর দুঃখের অন্ত থাকে না। তবুও অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হইলেও এইটাই সত্য যে, এই অনিশ্চিত জীবনযাত্রাই তাহাদের অভ্যস্ততায় পরিণত হইয়াছে, বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া।

আজ এইক্ষণে পশ্চিমাকাশে রক্তিম আভায় মোড়ানো সোনার থালাখানার দিকে চাহিয়া চাহিয়া এমনই আকাশ-পাতাল ভাবিতেছিলুম। ততক্ষণে সোনার থালাখানা অনেকটাই ম্লান হইয়া উঠিয়াছে। সন্ধ্যা আগতপ্রায়! চারিদিকে ঝকমকে সেই সোনারোদ আর নাই। মিইয়ে গিয়াছে, থিতিয়ে গিয়াছে বনবনান্তের ফাঁকে ফাঁকে। নদীর স্থির, শান্ত টলটলে জলে সূর্যদেব অবগাহন করিতেছেন। নদীর জলে তাঁহার প্রতিবিম্ব দেখা যাইতেছে। রক্তিমআভা জলে ছড়াইয়া গেলো।

নীড়ে ফেরা বিহঙ্গের পাখায় ভর করিয়া সন্ধ্যা নামিল। মনোরম সন্ধ্যা! একাকীত্বের বেদনা লইয়া সন্ধ্যা নামিল। সেতারের তারে পূরবীরাগের বিষণ্নতা লইয়া সন্ধ্যা নামিল। হায়! পৃথিবীতে কে কাহার! এমনই বিষণ্ন, বেদনাতুর, একাকী সন্ধ্যায়, নদীতীরে ঘনায়মান অন্ধকারে বসিয়া মনে হইতে লাগিল-সমস্ত চরাচর জনমানবশূন্য। পৃথিবীর কোথাও কেহই নাই। কী যেন হারাইয়া গিয়াছিলো, তাহার তরেই প্রাণখানা হায় হায় করিয়া মরিতে বসিয়াছে। বেশ জাঁকিয়া অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে, তাহার সাথে পৌষের হিম। আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর পরিণত চাঁদ! নিশাচর রাতপাখিদের আনাগোনা বাড়িয়াছে, তাহার সাথে বাড়িয়া চলিয়াছে উত্তরের হিমেল হাওয়া। হাড় কাঁপানো কনকনে সেই শীতের সন্ধ্যা ক্রমশই রাতের দিকে ধাবিত হইতেছে। আমি বাড়ি ফিরিবার পথ ধরিলাম। এমন বিচিত্র রূপবতী সন্ধ্যা জীবনকে ভাবনার অতল তলে টানিয়া লইয়া যায়। সেইখানে ব্যক্তি শুধুমাত্র একা একজন। কত শত ভাবনার জট খুলিয়া যায় তাতে, আবার কত শত ভাবনা ভূমিষ্ঠ হইয়া পরিপুষ্ট হইয়া ওঠে- তাহা কে বলিতে পারে? এমন নির্মেঘ, নির্মল সন্ধ্যা! নিজেকে একান্ত নিজের করিয়া লাভ করিতে পারিবার মতো স্নিগ্ধ সন্ধ্যা!

পূর্ববর্তী নিবন্ধশীত বুড়ি এসেছে
পরবর্তী নিবন্ধষড়ঋতু ও স্রষ্টা