পুলিশ হেফাজতে সাবেক দুদক কর্মকর্তার মৃত্যু

তিনি ওপেন হার্ট সার্জারি, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন : পুলিশ ।। থানায় ওষুধের ডোজ নিতে না দেওয়ার অভিযোগ ছেলের ।। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৫ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দুদকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (৫৮) চান্দগাঁও থানা পুলিশের হেফাজতে মঙ্গলবার গভীর রাতে মৃত্যুবরণ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিবারের অভিযোগ একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় দুদকের এই কর্মকর্তাকে সাদা পোশাকে এএসআই ইউসুফ ও এএসআই সোহেল আটক করে রাতে থানায় নিয়ে যায়। গতকাল চমেক হাসপাতালে পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এটি একটি হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার চাই।

এ ব্যাপারে সিএমপির উপকমিশনার (উত্তর) মো. মোখলেছুর রহমান আজাদীকে বলেন, এসএম শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি সিআর মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। চান্দগাঁও থানার একটি টিম তাকে মঙ্গলবার রাতে পরোয়ানামূলে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় ওসি থানায় ছিলেন না। এসএম শহীদুল্লাহকে থানায় আনার পর ওসি জানতে পারেন। তখন ওসি নির্দেশ দেন, উনি সম্মানিত লোক, তাকে আমার (ওসির) রুমে বসাও।

উপকমিশনার বলেন, শহীদুল্লাহ সাহেবের ওপেন হার্ট সার্জারি ছিল। তিনি ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। ওসির রুমে বসানোর পর তিনি অসুস্থবোধ করেন। তখন তার পকেটে থাকা স্প্রে দিয়ে তাকে স্প্রে দেওয়া হয়। এসময় তার পরিবারের লোকজনও উপস্থিত ছিলেন। তারপরেও তিনি সুস্থবোধ না করায় অ্যাম্বুলেন্স খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় উনার পরিবারের লোকজনসহ একটি সিএনজি টেক্সি করে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর বন্ধুদের মাধ্যমে জানা যায়, দুদক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ দীর্ঘদিন সততার সাথে দেশের দুর্নীতি দমনে কাজ করেছেন। চান্দগাঁও থানার মোজাহের উল্লাহ মুহুরী বাড়ির সৈয়দ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর ছেলে তিনি। দুদকের উপপরিচালক হিসেবে ২০১৭ সালের ১২ জুলাই তিনি অবসরে যান। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল দুদক চট্টগ্রাম২ সমন্বিত কার্যালয়। তারা বলেন, আমরা জানতাম, চান্দগাঁও এক কিলোমিটারে এক ব্যক্তির সাথে জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল তার। সে ঘটনার প্রেক্ষিতে আদালতে রণি আক্তার তানিয়া নামে এক অচেনা নারীকে দিয়ে একটি সিআর মামলা করা হয়। যার নং৭৩৩, ধারা৩২৩/৫০৬। শহীদুল্লাহর ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহীদ বলেন, চান্দগাঁও বাসায় ফেরার পথে রাত সাড়ে ১০টায় দুই পুলিশ সদস্য কোনো মামলার ওয়ারেন্ট ছাড়াই বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। উনার ন্যূনতম সম্মানটা পুলিশ রাখেনি। খুনের মামলার আসামির মতো করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

নাফিস শহীদ বলেন, আমরা ওয়ারেন্ট দেখতে চাইলে তারা দেখাতে পারেনি। পুলিশ যখন বাবাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমার চাচারাও পেছনে পেছনে গিয়েছেন। চাচারা যখন থানায় যান, তখন থানার কলাবসিবল গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাবা হার্টের রোগী হওয়ায় উনাকে নিয়মিত ইনহেলার ও মেডিসিন নিতে হয়। ভেতরে উনি যখন অসুস্থ অনুভব করছেন, তখন আমরা বাবাকে ওষুধের ডোজ দিতে চাইলে পুলিশ নিতে দেয়নি। পরে থানার ভেতরে তার মৃত্যু হয়। বাবা যখন মারা গেছেন, তখন অসুস্থ বলে পুলিশ বাবাকে হাসপাতালে নেয়। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদুল্লাহর ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহীদ বলেন, আমাদের জমি নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে বিরোধ ছিল। তবে মামলার বিষয়টি আমরা জানতাম না। বাবাও আমাদের জানাননি।

শহিদুল্লাহর শ্যালক কায়ছার বলেন, গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে কি করেছে জানি না। তবে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সুস্থই ছিলেন।

কায়ছার বলেন, রনি আক্তার তানিয়া নামে অজ্ঞাত এক নারীর মাধ্যমে দুই যুবলীগ নেতা আমিসহ আমার দুলাভাই শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে হুমকিধামকি ও মারধরের মিথ্যা অভিযোগে মামলা করান। সেই মামলায় ওয়ারেন্টও জারি হয়। আজ (বুধবার) সকালে চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিকুল ইসলামের আদালত থেকে জামিন নিয়ে আসি। তিনি আরও বলেন, এই কথিত দুই যুবলীগ নেতা আমার দুলা ভাইয়ের চাকরি জীবনের শেষ সম্বলটুকু দখলে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছিল। এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের করা চাঁদাবাজিসহ দুটি মামলা রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তার কোন ভিত্তি নেই। আর তাঁর সাথে থানায় পুলিশ কী ধরনের ব্যবহার করেছে তারও প্রমাণ আছে। একটা কথা বললেইতো আর হলো না। ওসি বলেন, একটি সিআর মামলার ওয়ারেন্টমূলে উনাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসি। মামলা হয়েছে আদালতে। আদালত নির্দেশ দিলে থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করতে বাধ্য।

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : এদিকে চান্দগাঁও থানায় গ্রেপ্তারের পর পুলিশ হেফাজতে দুদকের সাবেক কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নগর পুলিশ। এতে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর জোনের উপকমিশনারকে প্রধান করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় তিন সদস্যের কমিটিকে তদন্ত করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

কমিটির অপর সদস্যরা হলেননগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) এবং বিশেষ শাখার সহকারী কমিশনার। নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান আজাদীর কাছে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, দুদকের সাবেক কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় উনার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে বিধিবর্হিভূত কোনো কাজ করা হয়েছে কিনা এবং থানায় নিয়ে যাওয়ার পর তার সঙ্গে নিয়মবর্হিভূত কোনো আচরণ করা হয়েছে কিনাসেটা নির্ণয়ের জন্য কমিশনার স্যার তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক উপপরিচালক ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুকে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। একই সঙ্গে তারা এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।

গতকাল বুধবার সংগঠনটির সভাপতি মো. মশিউর রহমান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সই করা এক প্রতিবাদলিপিতে এসব তথ্য জানানো হয়। দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে দুদকের সাবেক উপপরিচালক ও দুদক পরিবারের সদস্য ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন। পরিবারের দাবি, পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আটকের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধও সঙ্গে নিতে দেওয়া হয়নি। গণমাধ্যমের খবর ও পরিবারের দাবি যদি সত্য হয়, তবে সেটি হবে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত গুরুতর অপরাধ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্রিকেটের বিশ্ব ট্রফির লড়াই শুরু আজ
পরবর্তী নিবন্ধআমি ব্যস্ত, ক্লাস নিচ্ছি