পুরনো যন্ত্রপাতির জগৎ

দোকান ও ব্যবসা দুটোই বেড়েছে

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৬ মার্চ, ২০২১ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

সড়ক থেকে আড়াই-তিন ফুট উপরে গাড়ির বিভিন্ন ধরনের নাটবল্টু। সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডালায়। দেয়ালে ও ছাদের প্রায় সবখানে মালার মতো গাঁথা নাটবল্টু। এক পাশে বসে আছেন কর্মচারী জাকির। গতকাল শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কদমতলীর মোড়ে তার সঙ্গে কথা। বললেন, গাড়ির সব ধরনের নাটবল্টু আছে আমার কাছে। সবই রিকন্ডিশন্ড, মানে পুরনো গাড়ির।
স্থানীয় দোকানদারদের কাছ থেকে নাটবল্টু সংগ্রহ করেন জাকির হোসেন। তবে চাহিদা থাকায় নতুন নাটবল্টু অল্প পরিমাণে রাখছেন। তিনি বলেন, আগের চেয়ে দোকানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তারপরও ভালো-খারাপ মিলিয়ে ব্যবসা চলছে। গাড়ির খুচরা যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় ধনিয়ালাপাড়ার ফুটপাত ধরে হাঁটা মুশকিল। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কারও মাথাব্যথা নেই। উল্টো দোকানদারদের হাঁকডাক, কী লাগবে ভাই? ভাই, কী খোঁজেন? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অস্থির হতে হয়।
নগরীর কদমতলী মোড়, ধনিয়ালাপাড়ায় কেবল নাটবল্টু নয়; গাড়ির পুরনো লাইট, আয়না, বিয়ারিং, পাখা, স্প্রিং, ব্রেক, বুস্টার, হ্যাঙ্গার, হুইল, টায়ার-সবই চাহিদা অনুযায়ী অল্প দামে পাওয়া যায়। দেশে গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার দোকান ও ব্যবসা দুই-ই বেড়েছে। মূল সড়ক ছাড়িয়ে আশেপাশের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে গেছে পুরনো গাড়ির যন্ত্রাংশের এই ব্যবসা। অধিকাংশ দোকানই এত ছোট যে তাদের যন্ত্রপাতি উপচে বেরিয়ে এসেছে ফুটপাতে কিংবা সড়কের উপর। ফুটপাতের উপর ফেলে রাখা হয়েছে গাড়ির পুরনো ইঞ্জিন। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ইঞ্জিনের নাটবল্টু খুলে সব যন্ত্রাংশ আলাদা করে ফেললেন শ্রমিকেরা। ইঞ্জিন থেকে পাওয়া যন্ত্রাংশ মহাজনের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে আশেপাশের বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি দোকানে। ধনিয়ালাপাড়ায় এক চক্কর দিতেই এসবের দেখা মিলল।
নিবিষ্ট মনে একটি হ্যাঙ্গার (গাড়ির চাকার উপর ব্যবহৃত হয়) ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছিলেন মো. সাগর। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। মাদারীপুরে বাড়ি। পুরনো যন্ত্রপাতির এই জগতে ১০ বছর ধরে কাজ করছেন। বললেন, এখানে বেতন কম। তবে উপরি ইনকাম বেশি। জানতে চাইলে পরিষ্কার করতে চাইলেন না সাগর। তবে বলেন, কাজ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বেশ আনন্দই লাগে। এসব বিষয়ে তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা চলল। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে সাগরের চোখ চকচক করে উঠল। চাকরি করে টাকা জমাচ্ছেন। কর্মচারী থেকে দোকানের মালিক হওয়ার স্বপ্ন তার। বললেন, মহাজন তো হবই। দেশের ভেতরে চলাচল করা পুরনো গাড়ি এবং তার যন্ত্রাংশের পাশাপাশি আমদানি করা পুরনো যন্ত্রপাতি বর্তমানে প্রচুর আসে ধনিয়ালাপাড়ায়। সড়কের একাংশ আর ফুটপাত দখল করে সেসব যন্ত্রাংশের মধ্য থেকে ব্যবহারের উপযোগী পণ্যগুলো খুঁজে বের করেন শ্রমিকেরা। তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এভাবেই জমজমাট থাকে ধনিয়ালাপাড়া। এখানে মোটর পার্টস ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর এক বিশাল সম্ভাবনাময় ভান্ডার গড়ে উঠেছে। পিস্টন, বিয়ারিং থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মোটর পার্টস, গাড়ির ব্রেকডাম, ইঞ্জিন, কার্টিজ, সকেট, জগ, জাম্পার, স্প্রিং, হ্যামার, ম্যাকেল জয়েন্ট, বল জয়েন্টসহ নানা মেশিনারিজ ও পার্টস পাওয়া যায় এখানে।
যতদূর জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন যানবাহন নিলামে দিলে তখনকার সময়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা সেইসব যানবাহন ক্রয় করেন। পরবর্তীতে এসব গাড়ির ইঞ্জিন এবং পার্টসগুলো আলাদা করে তারা ব্যবসা শুরু করে। সেই থেকে ধনিয়ালাপাড়ার পুরাতন গাড়ির ইঞ্জিন এবং পার্টসের ব্যবসার সূত্রপাত ঘটে। পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি ব্যবসায়ীরা এখানে প্রতাপের সাথে পুরাতন গাড়ির ইঞ্জিন এবং পার্টসের ব্যবসা করতে থাকেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ব্যবসা পুরোপুরি বাঙালিদের হাতে চলে আসে। বর্তমানে চট্টগ্রামের লোকেরা এই ব্যবসার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ধনিয়ালাপাড়ায় পুরনো (রিকন্ডিশন্ড) ইঞ্জিনের ব্যবসা শুরু হয় মেসার্স এমকে রহমান এন্টারপ্রাইজের হাত ধরে। তবে স্বাধীনতার আগ পর্যন্তও প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র তিনটি। বর্তমানে ২০০ ছাড়িয়েছে। এর সুবাদে ধনিয়ালাপাড়ার পরিচয় এখন রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিনের বাজার হিসেবে। ধনিয়ালাপাড়ায় যে ২০০টি প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এর মধ্যে প্রায় ১০০টি বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি ইঞ্জিন ও গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করে। পরে তা দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, সারা বছরই পুরনো ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশের চাহিদা থাকে। ছোট ট্রলার, নৌকা থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের গাড়ির ইঞ্জিন এখানে পাওয়া যায়। দাম ৩০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা। জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই ও থাইল্যান্ড থেকে এসব ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান এসব ইঞ্জিন বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারিতে বিক্রি করেন। সরকারি কোষাগারেও জমা পড়ে মোটা অংকের রাজস্ব।
চুরি বা ছিনতাই যাওয়া গাড়ির যন্ত্রাংশেরও শেষ ঠিকানা ধনিয়ালাপাড়া। অভিযোগটি পুরনো। বিষয়টি নিয়ে কৌতুক পর্যন্ত আছে। তবে ধনিয়ালাপাড়ায় এখন আর চুরি করা গাড়ি আসে না। সাত-আটজন ব্যবসায়ী মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে কথাটি বললেন। তাদের বক্তব্য, মাদকসেবীরা অনেক সময় গাড়ির লুকিং গ্লাস বা হেডলাইট খুলে নিয়ে বিক্রি করতে চলে আসে। তবে সেগুলো ভাসমান ব্যবসায়ীরা কেনে। ভালো ব্যবসায়ীরা কেউ কেনে না।
মোটর পার্টসের দোকান ছাড়াও এখানে রয়েছে লেদ মেশিন, ড্রাম শিট, পুরনো লোহালক্কড়ের দোকান। এছাড়া পুরনো গাড়ি ভেঙেও পার্টস সংগ্রহ করা হয় ধনিয়ালাপাড়ায়। বিক্রিযোগ্য এসব পার্টস বিভিন্ন গ্যারেজ থেকে এবং কিছু জিনিস নিজস্ব কারিগরি দক্ষতায় তৈরি করা হয়। এ ব্যবসা এখন শুধু ধনিয়ালাপাড়ায় হচ্ছে না, নগরীর মুরাদপুর, সাগরিকা, ঢাকার ধোলাই খাল ও বগুড়ায়ও হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ১০৭ জনের করোনা শনাক্ত
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে বাংলাদেশ