পিবিআইয়ের তদন্ত।।মিতুকে হত্যা করতে খুনিদের তিন লাখ টাকা দেন বাবুল

মূল পরিকল্পনাকারী শনাক্ত

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৫ আগস্ট, ২০২২ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তারকে আসামি করে করা মামলাটি অবশেষে চূড়ান্ত রূপ পেতে চলেছে। এতদিন ধরে খুনের নির্দেশদাতা প্রসঙ্গে ‘নানা মুনির নানা মত’ দ্বন্দ্বে ফেলেছিল তদন্ত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সারা দেশের মানুষকে। ঘটনার পেছনে কে রয়েছে, কে তাদের ভাড়া করেছিল- আড়ালেই থেকে যাচ্ছিল ঘটনার নেপথ্য নায়ক। ঘটনার পরপরই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল মিতুর খুনিরা ছিল ভাড়াটে এবং সংঘবদ্ধ খুনিচক্রের ভয়ংকর সদস্য। কিন্তু পরিকল্পনাকারী সম্পর্কে তাদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে উঠে এসেছে যে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার এবং খুনিদের তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক আবু জাফর মো. ওমর ফারুক আজাদীকে জানান, মাহমুদা হত্যা মামলায় পিবিআইয়ের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এতে বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। পিবিআইয়ের তদন্তের সঙ্গে একমত পোষণ করে অভিযোগপত্র দাখিলের পক্ষে গত মঙ্গলবার মত দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি। আগামী সপ্তাহে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে। বাবুল আক্তার ছাড়াও অভিযোগপত্রে নাম আসা অন্য ছয় আসামি হলেন মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম ওরফে কালু ও শাহজাহান মিয়া। এদের মধ্যে মুসা ও খাইরুল ঘটনার পর থেকে পলাতক। বাবুল, ওয়াসিম, শাহজাহান ও আনোয়ার কারাগারে আছেন। আর এহতেশামুল জামিনে আছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযোগপত্রে চারজনকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। এরা হলেন সাইদুল ইসলাম শিকদার ওরফে সাক্কু, নুরুন্নবী, মো. রাশেদ ও আবু নাছের। এদের মধ্যে রাশেদ ও নুরুন্নবী ঘটনার কয়েক দিন পর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
পিবিআই তদন্তে বলা হয়, গত বছরের ২৩ অক্টোবর ভোলা আদালতে জবানবন্দি দেন। এতে তিনি বলেন, বাবুলের নির্দেশে মুসা তাঁর স্ত্রী মাহমুদাকে খুন করেন। নির্দেশ না মানলে তাঁকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বাবুল। মুসা ঘটনার পর থেকে ‘নিখোঁজ’। অনেক চেষ্টা করেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।৬
অবশ্য মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, তার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে তার আর খোঁজ পাচ্ছেন না তাঁরা। এর আগে ২০১৬ সালে ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে জবানবন্দি দেন। তখন তারা বলেন, মুসার নির্দেশে তাঁরা মাহমুদাকে খুন করেন।
প্রসঙ্গত: ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মিতুকে। এই ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যাকাণ্ডের বছর খানেক পর থেকেই মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে আসছিলেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে তার মেয়ে মিতুকে খুন করা হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর আগে সেটি নগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করেছিল।
পিবিআইয়ের প্রস্তুত করা অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে, ঘটনা সংঘটনকারীদের অর্থ দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। স্ত্রী হত্যার তিন দিন পর বাবুল আক্তার তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হককে বলেন, তাঁর লাভের অংশ থেকে তাঁকে যেন তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়। সাইফুল বিকাশের মাধ্যমে ওই টাকা গাজী আল মামুনকে পাঠান। গাজী আল মামুন ওই টাকা মুসার কাছে পাঠান। গাজী আল মামুন ছিল খুনের মূল পরিকল্পনাকারী মুসার আত্মীয়। তিনি বলেন, সাইফুল ও মামুন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। এরপর আমরা সাইফুল বিকাশ করতে যাকে পাঠিয়েছিল তার ম্যানেজার মোকলেসুর রহমান ইরাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সে জানিয়েছে, ঘটনার পাঁচদিন পর এ টাকার লেনদেন হয়েছে বাবুল আক্তারের নির্দেশেই। ইরাদ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর ইরাদই মুসার দেওয়া বিকাশ নম্বরে তিন লাখ টাকা দিয়েছেন।
মাহমুদা খানম মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের দায়েরকৃত মামলায় এনজিও কর্মী গায়ত্রী অমর সিংয়ের নাম উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে তার সাথে পরকীয়ার বলী হয়েছেন এই মিতু। পুলিশের তদন্ত এবং মিতুর বাবার কাছ থেকে জানা গেছে সেই এনজিও কর্মী পরিচয়। তার পুরো নাম গায়ত্রী অমর সিং। ব্যক্তিগত জীবনে গায়ত্রী বিবাহিত এবং তার একটি ছেলে রয়েছে। বর্তমানে সুইজারল্যান্ড বা পূর্ব আফ্রিকার কোনো দেশে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআরের প্রটেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত গায়ত্রী। এরপর পিবিআই বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর ওমর ফারুক মামলার স্বার্থে ঘটনার অন্যতম প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী বাবুল মিতুর সন্তান মাহিরের সাথে কথা বলেছেন।
পিবিআইয়ের প্রস্তুত করা অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাবুল কঙবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার এক নারী কর্মকর্তার (গায়ত্রী) সঙ্গে বাবুলের সম্পর্ক হয়। ওই নারী তখন যে বাসায় থাকতেন, সেই বাসার নিরাপত্তাকর্মী সরওয়ার আলম ও গৃহকর্মী পম্পি বড়ুয়া গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। এতে দুজনই কঙবাজারে ওই নারীর বাসায় বাবুলের যাতায়াতের বর্ণনা দেন। ওই নারী বাবুলকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। মামলার আলামত হিসেবে এটি জব্দ করে পিবিআই। পরে আদালতের নির্দেশে হাতের লেখা পরীক্ষা করে দেখা যায়, উপহারের বইয়ে থাকা লেখা বাবুলেরই। ওই লেখায় তাঁদের দেখা, পরিচয়সহ নানা তথ্য রয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক ওমর ফারুক আরো বলেন, অভিযোগপত্রে বাদী বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করা ছাড়াও সাক্ষী রাখা হয়েছে ৯৭ জনকে। আগামী সপ্তাহে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহলুদ-কালো তরমুজে চমক
পরবর্তী নিবন্ধসড়ক দুর্ঘটনায় ট্রাক চালক বাস হেল্পারসহ নিহত তিন