পিতা ও গণদেবতা

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত | বৃহস্পতিবার , ১২ মে, ২০২২ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ


বঙ্গবন্ধু জেলে বসে লিখেছিলেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী, আর তাঁর সুযোগ্য সন্তান শেখ হাসিনাও জেলে বসে এই বইয়ের ভূমিকায় (২০১২) লেখেন, ‘এই লেখার সূত্র ধরে গবেষণা করলে আরও বহু অজানা তথ্য সংগ্রহ করা যাবে’। এমন প্রত্যাশা প্রকাশের এক যুগ পেরিয়েও আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত-গবেষকগণ যেখানে পুনর্পাঠ আর সহায়ক আলোচনায় প্রশ্নহীন প্রশংসায় পঞ্চমুখ; সেখানে কাঞ্চনা চক্রবর্তীর মতো অতি অল্পসংখক নবীন প্রাবন্ধিক কাঞ্চনমূল্যে অন্বেষণে অধীর হন জাতির পিতার যাপিত জীবনের ইতিহাস আর আমাদের গৌরবময় অর্জন-ঐতিহ্যের। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই এপ্রিলে ভৈরবী রাগে কাহারবা তালে লেখেন:

‘ওই মহামানব আসে। / দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে / মর্ত ধূলির ঘাসে ঘাসে ॥
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ, / নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক- / এলো মহাজন্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গ তোরণ যত / ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন,
উদয় শিখরে জাগে ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’ / নবজীবনের আশ্বাসে।
‘জয় জয় জয় রে মানব অভ্যুদয়’ / মন্দ্রি-উঠিল আকাশে ॥’

‘বিদ্রোহী-বীর’ বাঙালি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে স্বাধীন মানুষ হয় উনিশশ’ একাত্তরে। আর তাঁদের মুক্তির মন্ত্রে উদ্দীপিত করে তোলেন যে মহামানব, তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। সংস্কৃত ভাষায় পিতার প্রণাম মন্ত্রে আছে : পিতা স্বর্গ পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমং তপঃ॥ পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা॥’ সে অর্থে পিতা যথার্থই দেবতা; কিন্তু ‘গণদেবতা’! তাও আবার ‘গণমানুষের’! পাঠকমাত্রেই বিমুগ্ধ বিস্ময়ে অধ্যয়নে আগ্রহী হতে বাধ্য এমন চমৎকার শিরোনামের গ্রন্থ। এমন প্রেক্ষাপটে বিচার্য অধ্যাপক ও গবেষক কাঞ্চনা চক্রবর্তী বিরচিত নয়টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত গণমানুষের গণদেবতা (২০২০) বইটি।

চট্টগ্রাম সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রিয় মুখ প্রফেসর রীতা দত্তকে উৎসর্গ করা বইটির প্রথম ফ্ল্যপ পড়েই মনে হয় প্রাবন্ধিক কাঞ্চনা চক্রবর্তী যথার্থই মনে করেন, বাংলাদেশকে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। প্রকৃত গবেষণার মাধ্যমে জাতিকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মানসিক দিক, চিন্তা, জাতির জন্য স্বপ্ন-ত্যাগ আর বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস যত বেশি তুলে ধরা হবে, আগামী প্রজন্ম তত বেশি সমৃদ্ধ হবে। পাঠকের অনুধাবনে অসুবিধা হয় না যে আগামী প্রজন্মের জন্য স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রত্যাশায় আলোচ্য প্রাবন্ধিক কলম ধরেন।

গণমানুষের গণদেবতা গ্রন্থের শুরুতেই গ্রন্থের নাম-প্রবন্ধ। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই প্রবন্ধে প্রফেসর সন্নিবেশিত করেছেন আমাদের জাতির পিতা কীভাবে সাধারণ জনজীবন থেকে বা গণমানুষ থেকে উঠে এসে আমজনতার দাবি আদায়ে অগ্রসর হচ্ছেন। তারপর তাঁর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতি অল্পদিনে তিনি জননেতায় রূপান্তরিত হয়ে কীভাবে জেল-জুলুম সহ্য করছেন আর ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসছেন। গণদেবতা শব্দের আভিধানিক অর্থ: সঙ্ঘভূত দেবগণ (যথা ৪৯ বায়ু, ৮ বসু, ১২ আদিত্য ইত্যাদি); গণশক্তির অধিদেবতা (শৈলেন্দ্র: ১৯৭১: ১৮৯)। গণপতি বলতে কোথাও গণেশ আবার কোথাও শিব ঠাকুরকে বোঝানো হয়।

দুজনেই সাধারণ জন থেকে এসে দেবত্ব লাভ করেন। আমাদের বঙ্গবন্ধুও ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়া থেকে এসে পাকিস্তান-আন্দোলনে মুসলিম লীগের কর্মী, পাকিস্তান রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রথম গ্রেফতার বরণকারীদের অন্যতম, আওয়ামীলীগের নেতা থেকে শেষে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার শেষ দু’পঙক্তির মতো যেনো মুজিবের স্বতগোক্তি শুনি: ‘আমি চির-বিদ্রোহী বীর- / বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’। বঙ্গবন্ধু তাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তিনি অনন্য অফুরান।
‘বঙ্গবন্ধু তুমি আলো বাতিঘর’ প্রবন্ধের নাম থেকেই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু পরিষ্কার। বাংলাদেশের নামকরণ, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্বাচন ইত্যাকার বিষয়ে জাতির পিতার অবদান মূল্যায়িত হয়েছে প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎস-কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পঙক্তি।

প্রকৃতপক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘নবযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধের শেষে প্রবন্ধোক্ত উক্তি ব্যবহার করেছিলেন। অবশ্য ভাঙার গান (১৯২২) কাব্যগ্রন্থের পূর্ণ-অভিনন্দন কবিতায় নজরুল প্রথম ‘জয় বাঙলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন: ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ,’।

একইভাবে এই গ্রন্থে আরও বেশকিছু কবিতার পঙক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, তবে কবিতাংশগুলোর কবির নাম না জানিয়ে যেমন পাঠককে বঞ্চিত করেছেন কাঞ্চনা চক্রবর্তী তেমনি কবিগণও বঞ্ছনা-ব্যথায় ব্যথিত। গদ্য বা প্রবন্ধের উদ্ধৃতির ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট স্টাইলশীট না হোক অন্তত গ্রন্থের নাম/ পৃষ্ঠা নম্বর সংযোজন করা গেলে বইটির মর্যাদা আরও বাড়তো বৈকি। ‘বঙ্গজননী’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা’ প্রবন্ধ দুটিতের বঙ্গবন্ধুর অবদানের পাশাপাশি তাঁকে প্রেরণা দানকারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের অবদান আলোচনা করেছেন সহজ সাবলীল ভাষায়। ‘দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহী’ প্রবন্ধে বর্ণিত হয়েছে মাস্টারদা সূর্যসেনকে কীভাবে ধরিয়ে দেন তাঁর সহকর্মী ব্রজেন সেন এর সৎভাই দেশদ্রোহী লোভী নেত্র সেন এবং নেত্রসেনকে কতল করে প্রতিশোধ নেন কিরণ সেন। তবে এই প্রণম্য ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বিবরণ শুনতে প্রাবন্ধিক পাঠককে প্রলুব্ধ করেদেন অনায়াসে। ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম, সূর্যসেন আর স্বাধীনতা একটি ত্রিভুজের তিনটি বাহু’(পৃ.২৯)। এধরনের বেশ কিছু বাক্য বিনির্মাণে কাঞ্চনা নতুন ব্যঞ্জনা আনেন।

‘বীরাঙ্গনার সম্মান’, ‘চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বই’ ও ‘চট্টগ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান’ প্রবন্ধ তিনটিতেও প্রাবন্ধিকের স্বদেশপ্রেম আর অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালনের অভাস যেমন পাই, তেমনি জন্মজনপদের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ আর ঋণশোধের আকাঙ্ক্ষাও অব্যক্ত থাকে না। ‘হে মৃত্যুঞ্জয়ী’ প্রবন্ধে বর্ণিত হয়েছে, “কীভাবে আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক সবার ‘মুজিব ভাই’ আর ‘বাংলার খোকা’ হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু” (পৃ.৫৫)। এই ইতিহাস আলোচনায় প্রাবন্ধিক তুলে আনেন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান (১৯৬৯) এর আরও আগে চট্টগ্রামের আনোয়ারা অঞ্চলের সন্তান ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক কর্তৃক (১৯৬৮) সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের প্রকাশ। এভাবে বিচিত্র ইতিহাসের অনুষঙ্গের প্রতি আমাদের আগ্রহ আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করে দেন প্রাবন্ধিক কাঞ্চনা চক্রবর্তী। প্রবন্ধগুলো পড়তে পড়তে পাঠকেরও মনে হবে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশ সমার্থক। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত এক ঝাঁক সোনার মানুষ নিয়ে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বইটি প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করবে। এখানেই প্রাবন্ধিক কাঞ্চনা চক্রবর্তীর কৃতিত্ব।

[গণমানুষের গণদেবতা : কাঞ্চনা চক্রবর্তী। প্রকাশক : শৈলী প্রকাশন, চট্টগ্রাম। প্রচ্ছদ : উত্তম সেন। প্রকাশকাল : মার্চ ২০২২। মূল্য ২০০ টাকা।]

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সিইউএফ কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন উপভোগ্য
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর