পাহাড়ে জঙ্গি শিবিরে বিদ্রোহ, পাহাড়ি সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর দিল পুলিশ

| শুক্রবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

নতুন যে জঙ্গি দলটি পাহাড়ে আস্তানা গেঁড়েছিল, তাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে বিদ্রোহ হয়, যে জন্য শাস্তির মুখেও পড়তে হয়েছিল কয়েকজনকে; আবার সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে পাহাড়ি একটি সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহতও হন। ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে জড়িত অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গতকাল বৃহস্পতিবার এই খবর দিয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই জঙ্গি দলের ভেতরকার এই খবর দিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এটা ‘বিরাট এক গল্প’। পাহাড়ে ‘হিজরত’ করে এক বছরের বেশি সময় জঙ্গি শিবিরে থাকা ওই দুজনকে বুধবার গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা হলেন- সিলেটের মাদ্রাসাছাত্র সাইফুল ইসলাম তুহিন (২১) ও ঢাকার শেরেবাংলা নগরের এগ্রিকালচার ট্রেইনিং ইনস্টিটিউটের (এটিআই) ছাত্র নাঈম হোসেন (২২)। আসাদুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার দুজন হিজরতের প্রেক্ষাপট, পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং সেখানে ফেরত আসার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে।

হঠাৎ বাড়ি ছাড়া কিছু তরুণের খোঁজ করতে গিয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন জঙ্গি দলের খবর প্রথম জানিয়েছিল র‌্যাব। এই সংগঠনটির সঙ্গে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (বম পার্টি) যোগসাজশের কথাও জানানো হয়েছিল। খবর বিডিনিউজের।

র‌্যাব জানিয়েছে, ঘর ছাড়া ৫৫ তরুণের মধ্যে ৩৮ জনকে তারা চিহ্নিত করেছে এবং তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। এই পর্যন্ত ওই জঙ্গি দলের ৩০ জনের মতো সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র‌্যাব। এর মধ্যে এই জঙ্গি দলের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের ছেলে সাদিক সাইফুল্লাহ রাফাতসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। এরপর শফিকুরকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এখন আরও দুজনকে গ্রেপ্তারের খবর দেওয়া হল।

সংবাদ সম্মেলনে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড়ে ‘হিজরত’ করে এক বছরের বেশি সময় ক্যাম্পে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এরকম দুজনকে বুধবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ‘হিজরতের’ প্রেক্ষাপট, পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং সেখান থেকে ফেরত আসার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে।

সিটিটিসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাইফুল ইসলাম তুহিন তাবলিগে যাওয়ার কথা বলে গত বছরের ১৫ নভেম্বর বাড়ি থেকে বের হন। দুদিন পর তাকে নিখোঁজের খবর দিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে ওসমানী নগর থানায় একটি জিডি করা হয়। সাইফুল এক মাওলানা সাথে আরো দুজন গত বছরের ১৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে বান্দরবানে ‘হিজরত’ করে। তাদের সাথে যুক্ত হয় সিলেট থেকে আরও চারজন। গ্রেপ্তার আরেকজন নাঈম হোসেন শেরেবাংলা নগরের এটিআইতে কৃষি ডিপ্লোমার চতুর্থ সেমিস্টারে পড়েন। থাকতেন এটিআইর হোস্টেলে। গত বছরের ২ অক্টোবর কাউকে কিছু না বলে হল ছাড়েন তিনি। পরদিন তার পরিবার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডি করে।

সিটিটিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মাদ্রাসার এক হুজুরের মাধ্যমে তিনি উগ্রবাদে দীক্ষিত হন এবং জঙ্গি সংগঠনে নাম লেখান। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা ফিরে এলেও জঙ্গিদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখছিলেন। পরে নভেম্বরের ৮ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে সে আরও প্রায় ১২-১৩ জন কুমিল্লা থেকে বান্দরবানে যায়। এবং কেটিসি ক্যাম্পে পৌঁছে।

বিদ্রোহের শাস্তি নির্যাতন : গ্রেপ্তার তুহিন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সিলেট থেকে যাওয়া চারজন সেখানে থেকে চলে আসতে চাইলে তাদের টানা কয়েকদিন গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়, এক বেলা খাবার দেওয়া হয়। এরপর তাদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করা হয়, তাতে বলা হয়, ২০২৩ সাল পর্যন্ত থাকতে হবে। একদিন এই চারজন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যান এবং বমদের হাতে ধরা পড়েন। তখন তাদের উপর নেমে আসে অমানুষিক অত্যাচার।

সিটিটিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাদের ১০০/৬০/৫০টি করে দোররা মারা হত। তাদের সঙ্গে দাস-দাসীদের মতো আচরণ করা হত।

প্রশিক্ষণকাল : সাইফুল ও নাঈম পুলিশকে বলেছেন, বম পার্টি কেটিসি ক্যাম্পে তারা প্রায় ৪ মাসের মতো ছিলেন। প্রথম ৩০ দিন তাদের ১২ জনকে কেএনএফ সদস্যরা পাশের পাহাড়ে ট্রেনিং করায়। সে সময় তাদের পিটি-প্যারেড, ক্যাম্প পাহারা, রসদ সংগ্রহ, ঘর তৈরি ও রান্না-বান্নার কাজ করতে হত। এ সময় আরও কিছু ‘হিজরতকারী’ সেখানে পৌঁছায়।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার দুজন জানায়, শামীম মাহফুজ ওরফে স্যার এই দলটির মূল নেতা। তার পরিকল্পনা অনুসারেই ক্যাম্পের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হত। ক্যাম্পে আমির ওরফে আনিসুর ওরফে মাহমুদ, তমাল, রাকিব, ডাক্তার ভাই ওরফে ডা. শাকের, ক্যাম্প কমান্ডার কারসে ওরফে শিব্বির সবাই স্যারের পরামর্শ নিয়েই কাজ করত।

পাহাড়ি দলের সঙ্গে সংঘর্ষ : সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রশিক্ষণের কয়েক দিন পর তারা ভারতের মিজোরাম ‘হিজরত’ করে। কিন্তু সেখানে ঢুকতে না পেরে তারা আবার হেঁটে একটি পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এই ক্যাম্পে হঠাৎ একদিন আরেকটি পাহাড়ি দল জেএসএস হামলা চালায়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তখন ব্যাপক গোলাগুলি হয় এবং তাতে ডা. আহমদ নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পরদিন জানাজা শেষে শামীম মাহফুজ এই ক্যাম্পের নাম দেয় শহীদ ডা. আহমেদ ক্যাম্প। পরবর্তীতে ওই ক্যাম্প ছেড়ে তারা সিপ্পি নামের পাহাড়ে নতুন করে ক্যাম্প তৈরি করে। এর নাম রাখা হয় ‘সিপ্পি ক্যাম্প’।

সিটিটিসি জানিয়েছে, তারা চলে আসার পর এরপর গত ২৫ নভেম্বর তুহিন, নাঈমসহ তিনজন সমতলে পৌঁছান। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় সিটিটিসি খবর পেয়ে যায় এবং তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় তুহিন ও নাঈমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশব্যাপী ২০২১ সাল থেকে ৭০ থেকে ৮০ জনকে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ তাদের সংগঠনে যুক্ত করেছে। পাহাড়ে তাদের আস্তানা গাঁড়ার উদ্দেশ্যে ছিল সেখানে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি এবং প্রশিক্ষণ নেওয়া। সেখান থেকে নেমে এসে নাশকতা চালিয়ে আবার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদলীয় পদে ফিরতে মুরাদের ‘সাধারণ ক্ষমার’ আবেদন
পরবর্তী নিবন্ধঢাকায় দূতাবাসকর্মীদের নিরাপত্তা চাইল যুক্তরাষ্ট্র