বর্ষার শেষ দিকে আগস্টে বন্যা বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা। তবে সেই বন্যা এবার দেখা গেল দেশের ভিন্ন প্রান্তে। অন্য সময় উজানের পানিতে উত্তরাঞ্চলে এমন বন্যা হলেও এবার ঢলে ডুবল পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি শহর বান্দরবান। কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বান্দরবান শহর তলিয়ে গতকাল রাত পর্যন্ত পানিবন্দি অবস্থায় ছিলেন লাখো মানুষ। পাহাড়ি ঢলে মানুষ ভেসে যাওয়া ও পাহাড় ধসে মাটিচাপার মতো ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি।
প্রশ্ন হলো, পাহাড়ের শহর কেন পানিতে ডুবল? বান্দরবান শহরটি আশাপাশের তুলনায় নিচু স্থানে। শহরের পাশ দিয়ে শঙ্খ নদী বয়ে চলে। রুমা ও থানচির পানি শঙ্খের বান্দরবান শহর অংশ হয়ে নিচে নামে।
স্থানীয়রা বলছেন, তিন দশক আগে বান্দরবান শহর অংশে শঙ্খ নদীতে অনেক বড় বড় পাথর ছিল। নদীর দুই পাড় ছিল উঁচু। পাথর তুলে তুলে বিক্রি করা হয়েছে। নদীতে পাথর না থাকায় ঢলে নেমে আসা মাটিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। খবর বিডিনিউজের।
বান্দরবান শহরের চারপাশে তুলনামূলক উঁচু পাহাড়। শহরটি মাঝের নিচু অংশে। তাই নদীতে উপচে পড়া পানি হলে তা শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
বাসিন্দারা বলছেন, বান্দরবান শহর ঘিরে অপরিকল্পিত বসতি তৈরি হয়েছে। মূ্ল শহরে জমির দাম বেশি হওয়ায় আশেপাশের পাহাড় টিলায় জমি কেনা–বেচা চলে। এরপর জমি টিলা–পাহাড় কেটে স্থাপনা করেছে। বর্ষায় পাহাড় কাটা মাটি নামে পানির সঙ্গে মিশে, তারপর গিয়ে পড়ে শঙ্খে। এছাড়া পাহাড়ি ছড়া ও নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় জেলার বিভিন্ন উপজেলার উঁচু পাহাড়গুলো থেকে সব পানি নামে শঙ্খে।
বনভূমি উজার, পাথর তোলার পরিণাম যে কী হতে পারে, তা এখন দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন বান্দরবান সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ঝিরি–ঝর্নাগুলো বারো মাস চলমান ছিল, এখন নেই। শুধু বর্ষায় দেখা দেয়। সমস্ত ডিবি–ঝর্নার পানি নদী শঙ্খ নদীতেই নামে। বিকল্প কোনো পানি নামার ব্যবস্থা নেই। এখন যদি শঙ্খ নদীর পানি বাড়ে রুমা, থানচি, বান্দরবান অনিবার্য কারণে ডুবছে। এদিকে মাতামুহুরী নদীর পানিতে লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়িও ডুববে, এটাই বাস্তবতা।
পার্বত্য এলাকার পরিবেশ বিনষ্টের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়নকেও দায়ী করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, যে শঙ্খ নদী খরস্রোতা ছিল, তাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। বন উজাড় করায় পাহাড়ের মাটি ক্ষয় এত বেড়েছে যে নদীর আগের নাব্যতা আর নেই। অল্প পানিতেই ফুলে ওঠে। আমাদের কোনো জোয়ার–ভাটা নেই, শুধু পানি নামে। এ পানি যদি নামতেই না পারে, তাহলে সেটা ফুলে উঠবেই। ১৯৯৭ সালের পর এবারই বান্দরবান সবচেয়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানান তিনি। বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ন চলতে থাকলে সামনে আরও ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ দৃষ্টিতে দুর্যোগের কারণ : বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, এবার বৃষ্টিপাত মাত্রা ছাড়ানো, তার মধ্যে পূর্ণিমার জোয়ারের কারণে দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে পানি নামায় দেরি হচ্ছে। আর পাহাড় কাটা, বন উজাড়সহ ভূমির ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হচ্ছে।
তিনি বলেন, পানি ধরে রাখার আধার নষ্ট হচ্ছে। পানি যেগুলোতে ক্যারি হয়, খাল–বিল এগুলোর ক্যারিং ক্যাপাসিটি কমে যাচ্ছে। মাটির নিচে সারফেসকে আমরা আরবান করছি। এ তিনটিই আমাদের প্রধান সমস্যা।
বান্দরবানের মতো সব শহরেই অপরিকল্পিত নগরায়নকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ড্রেনেজের পথ ক্লোজ হয়েছে, ময়লা পরিষ্কার হয় না, সব সলিড ওয়েস্ট কালেক্ট হয় না, আগে যতটুকু পানি আসত এখন অনেক বেশি পানি আসছে। আগে যেখানে মাটির নিচে পানি ইনফিলট্রেট হত, সেখানে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর করে ফেলেছি। লেক, পুকুর আগে যেখানে পানি জমত, সেখানে সবগুলো ধীরে ধীরে ট্রান্সফার করছি।
আবহাওয়াগত পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, একদিকে বৃষ্টি কম হচ্ছে, আবার যখন হয় অনেক বেশি হচ্ছে। ল্যান্ড ইউজের পরিবর্তন তো আছেই। নগর ব্যবস্থাপনায় নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। শহরকে বিস্তৃত করতে হবে, এডাপটেশন ও নেচার কনজারভেশন করে এগোতে হবে।
চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগের পাশাপাশি ঝুঁকিপুর্ণ বসতি স্থাপনকারীদের সচেতন করার বিষয়ে জোর দিয়ে এসেছি। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ না থাকলে পাহাড়ি ভূমি ধসে প্রাণহানির তালিকা বাড়বে।
ভূতত্ত্বের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার পাহাড়ি এলাকার বাস্তবতা বিবেচনা করে পরিকল্পিত নগরায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, যে এলাকায় একবার পাহাড় ধস হয়েছে, সেখানে পাঁচ–দশ বছরে নতুন করে সম্ভাবনা কম। কিন্তু যেখানে হয়নি, সেখানে পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ে।