পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে

| বুধবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

পারিবারিক বন্ধন ধীরে ধীরে আলগা হয়ে পড়ছে। পরিবারগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। মা-বাবার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছেন সন্তানেরা। এক পরিবারে থেকেও মা-বাবা ও সন্তানেরা দিন কাটাচ্ছেন যে যাঁর মতো করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন আর আগের মতো দৃঢ় নয়, হয়ে পড়েছে বড়ই ঠুনকো। পত্রিকান্তরে এ বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালিত হয়েছে। তাতে তরুণদের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। তরুণেরা বলছেন, পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া বিষয়েই তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি। মা-বাবার সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বাড়ছে। মা-বাবা দুজনেই আয়-রোজগারে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণেই কি দূরত্ব কমছে না, এ প্রশ্নটাও এসেছে জরিপে। সব মিলিয়ে মা-বাবা ও পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে তরুণেরা আগের মতোই বেজায় উদ্বিগ্ন।
পরিবার নিয়ে গুণগত জরিপেও দেখা গেছে একই চিত্র। গুণগত জরিপে ২০ জনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন ছিলেন বিশেষজ্ঞ আর সাতজন পুরুষ ও সাতজন নারী। তাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, দেশের তরুণেরা কি আগের তুলনায় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন, তাঁরা কি অনলাইনে খুব বেশি অনুৎপাদনশীল সময় কাটাচ্ছেন এবং ক্রমশ মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। তরুণেরা এ বিষয়ে বলছেন, সন্তানেরা মা-বাবার কাছ থেকে মনোযোগ ও সময় পাচ্ছেন না। বিশেষ করে মা-বাবা উভয়েই কর্মজীবী হলে এই সংকট আরও তীব্র হয়। বাবা-মায়েরাও সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে (ফেসবুক, ইউটিউব প্রভৃতি) আসক্ত হয়ে পড়ছেন। কিছু ক্ষেত্রে সন্তানকে টেলিভিশনে কার্টুন সিরিজ দেখতে বসিয়ে বাবা-মায়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাচ্ছেন। আবার জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের একাংশ বলছেন, বাবা-মায়েরা কিছু ক্ষেত্রে সন্তানদের ওপর শৃঙ্খলার বিষয়টি চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত কঠোরতা দেখাচ্ছেন। তাঁরা সন্তানদের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিচ্ছেন পড়াশোনার বিষয়েও। কিন্তু সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে মা-বাবার আগ্রহ কম। ফলে সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সন্তানদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে, তাঁরা আটকে পড়ছেন মাদক ও হতাশার ফাঁদে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-বাবা ও সন্তানদের মধ্যকার এই ক্রমবর্ধমান দূরত্ব কমাতে এগিয়ে আসতে হবে মা-বাবাকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদলে সন্তানদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মা-বাবার দেখাদেখি সন্তানেরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে সন্তানদের আচরণে পরিবর্তন আসছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টিও সন্তানদের শেখাতে হবে মা-বাবাকেই।
আধুনিক সময়ে মানুষ যত বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হচ্ছে তত তার আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবও বাড়ছে। সংযুক্ত পরিবার ভেঙে টুকরো হতে হতে নিউক্লিয়ার পরিবারে এসে থেমেছে। সফল হওয়ার খেলায় মেতে মানুষ ভুলে যায়, আসলে সে কতটা একা হয়ে যাচ্ছে। এক সময় দেখা যায় তার পাশে আর কেউ নেই। একথা অস্বীকার করলে চলবে না, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার পরিবার। কিন্তু আজকাল পরিবারের মধ্যে এমন পারিবারিক বন্ধন দেখা যায় না। সকলেই যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। একই পরিবারে থেকেও পরস্পরের সঙ্গে কথা হয় না। যে যার ব্যস্ততায় জীবনযাপন করে। কারও দুদণ্ড জিরোবার অবকাশ নেই। পরস্পর-কে বলার মতো কোনও কথা নেই।
বর্তমানে পরিবারের বন্ধন ব্যাপকহারে ভেঙে যাচ্ছে। এই কারণেই আমাদের সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে চলেছে দিন দিন। আগে এক সময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল যাতে, অসুবিধার তুলনায় সুবিধার দিকটাই ছিল বেশি। সকলেই বিপদে আপদে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতেন। ঈদ, পুজো, নববর্ষ যাপন করতেন একসঙ্গে। পারিবারিক খাওয়াদাওয়া, হইহুল্লোড়- সব মিলিয়ে একটা জমজমাট ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে ছবিটা এর ঠিক উলটো। একদিকে যেমন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, তেমনি স্বামী -স্ত্রী তাদের মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করছেন। আর এখন তো দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ পরিবারে স্বামী-স্ত্রীও মিলেমিশে থাকতে পারছেন না। মতবিরোধ আর ইগোর লড়াই শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদে পরিণত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীদের অভিযোগ- স্বামী দীর্ঘক্ষণ কর্মের মধ্যে ব্যস্ত থাকায় স্ত্রীকে বেশি সময় দিতে পারেন না। রাগারাগি, ঝগড়া-বিবাদ এসব পরিবারে লেগেই থাকে। এক সময়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব লেগে যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে