ক্যালেন্ডারের বাহারি পাতায় আমরা প্রায়ই তাদের দেখতে পাই। ফি-বছর বেড়াতে গেলে তাদের সঙ্গে কয়েকটা সেলফি না থাকলে তো হবেই না! ঢেউ খেলানো সবুজ গালিচার সৌন্দর্যে বিভোর হই। তাদের ফলানো ফসলে আমাদের প্রতিটি ভোর আর সন্ধ্যা হয়ে ওঠে চনমনে-সতেজ। অথচ বরাবরের মতোই আমরা ভুলে থাকি এসব সুন্দরকে ‘সুন্দর’ রাখার পেছনে যারা নিরলস কাজ করছেন তাদের কথা।
বলছি বাংলাদেশের দেড়শ’র বেশি চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে যুক্ত নারীদের কথা। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট এবং চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত এসব বাগানে নিয়োজিত শ্রমিকের অর্ধেকের বেশি নারী। এই শিল্পের, পাতা বা কুঁড়ি তোলার প্রধান কাজটি করেন নারী চা-শ্রমিকেরা। পাশাপাশি নার্সারিতে চারা কলমের কাজটিও তারা পালস করেন দক্ষতার সাথে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারী শ্রমিকেরা এই কাজ করে গেলেও কাজের ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তার অনেক কিছুই তারা পান না। এই নারীরা অর্থ উপার্জন করলেও এখনো পরিবারে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে। তাদের দৈনিক মজুরি এখনও মাত্র ১২০ টাকা! বাগানের অভ্যন্তরে নারী শ্রমিকদের জন্য কোনো শৌচাগারের ব্যবস্থাও নেই। ফলে বাধ্য হয়ে তারা খোলা জায়গা ব্যবহার করেন। প্রস্রাব-পায়খানা দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। পিরিয়ড বা মাসিকের সময় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করেন বা অনেকে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর উপায় অবলম্বন করেন।
প্রসব-পূর্ববর্তী নিরাপদ মাতৃসেবা এবং প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা থেকে তারা বরাবরই বঞ্চিত। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, তারা সরকার নির্ধারিত মাতৃকালীন ছুটি থেকেও বঞ্চিত। অতিরিক্ত ভার বহনের ফলে গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটে থাকে যা বাগানের একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রায় সকল সদস্য একবাক্যে অভিযোগ জানিয়ে থাকেন যে, নারী চা শ্রমিকরা প্রসব-পূর্ববর্তী নিরাপদ মাতৃসেবা এবং প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা থেকে বরাবরই বঞ্চিত। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। কারণ পাতা তোলা শ্রমিকদের মধ্যে নারীরাই পঁচানব্বই শতাংশ এবং তাদের করতে হয় চা শিল্পের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর এই কাজ।
সমস্যার আরও রকম রয়েছে। চা বাগানে রোগ-বালাই ও পোকামাকড় দমনে চা গাছগুলোতে রাসায়নিক সার মিশ্রিত বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করায় শ্রমিকদের মানবস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশ শ্রম আইনে শ্রমিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চশমা, হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, এপ্রোন, জুতা ইত্যাদি সামগ্রী প্রদানের কথা রয়েছে। কিন্তু আসলে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চা শ্রমিকরা প্রায় অভিযোগ জানান, চা গাছের রোগব্যাধি দূরীকরণ, পোকামাকড় দমন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও ঘাস মারার জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক স্প্রে করা হয়। কিন্তু এসব কীটনাশক ব্যবহারে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক ন্যূনতম পোশাক প্রদান করেন না বাগান কর্তৃপক্ষ। তবে কিছু বাগানমালিক নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের জন্য কিছু উদ্যোগ নিলেও তা অত্যন্ত অপ্রতুল।
চা বাগানের শ্রমিক বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন। তারা প্রতিনিয়ত চা বাগানের নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা তথা অধিকার আদায়ের জন্য আওয়াজ তুলছেন। তাদের দাবি খুবই যৌক্তিক। এখানে সেইসব দাবিসমূহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করছি। নারী শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করা আশু প্রয়োজনীয় একটি দিক। কেননা এতে করে তারা তাদের জীবনমান উন্নয়নে সচেষ্ট হতে পারবে। এছাড়াও নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস নিশ্চিতকরণ, মাসের বিশেষ দিনে (মাসিক চলাকালীন প্রথম দুই দিন) স্বাস্থ্য ছুটির ব্যবস্থা, প্রতিটি বাগানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং ক্লিনিকে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটারি প্যাডের মজুদ রাখা, বর্ষায় বর্ষাতি এবং গ্রীষ্মে রোদ-ছাতা সরবরাহ, প্রসূতি নারীসহ যেকোনো স্ত্রীরোগের চিকিৎসার জন্য নারী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই লেখাটির মধ্যে দিয়ে আমি এই সকল ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানাই। যারা পড়লেন এই ছোট্ট নিবন্ধটি, আশা করি তাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে আরও ভাববেন। আওয়াজ তুলবেন। নিশ্চয়ই আমাদের এই আওয়াজ সেই সকল নারী শ্রমিকদের জীবনে নিরাপত্তা ও আনন্দের উপলক্ষ হয়ে উঠবে।