আট বছরে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে, আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন হচ্ছে। চীনা সহযোগিতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল খালাস হবে পাইপলাইনের মাধ্যমে। ১১ দিনের কাজ সম্পন্ন হবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায়। সিস্টেম লস কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৮শ কোটি টাকা। গভীর সাগর থেকে জ্বালানি তেল খালাসে ইস্টার্ন রিফাইনারির প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শেষ মুহূর্তের কর্মকাণ্ড চলছে দ্রুত গতিতে।
সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত অবস্থায় এই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধনের জন্য বছরে অন্তত ১৫ লাখ টন জ্বালানি তেল অপরিশোধিত অবস্থায় এবং বাকি তেল পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করা হয়। সব তেল আনা হয় সাগরপথে। বড় মাদার ভ্যাসেলে তেল আনা হয়। এসব জাহাজ বন্দর চ্যানেলে বার্থিং নিতে পারে না। জাহাজগুলো বহির্নোঙরে অবস্থান করে। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের লাইটারেজ জাহাজ দিয়ে এই তেল লাইটারিং করে পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপোতে আনা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ। মাদার ভ্যাসেল থেকে তেল খালাস করতে ১১ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ জড়িত থাকে। এতে শুধু লাইটারেজ জাহাজের ভাড়া নয়, একই সাথে অলস বসে থাকা মাদার ভ্যাসেলগুলোর ভাড়া বাবদ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা গচ্ছা দিতে হয় বিপিসিকে।
জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় ও অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলেছিল। পরে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন আগ্রহ দেখায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা এবং পরে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চীনের এঙ্মি ব্যাংকের চুক্তি হয়।
৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তায় ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন (এসপিএম) শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় চায়না পেট্রোলিয়াম ব্যুরো বঙ্গোপসাগরের মহেশখালীর পাশে গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণ এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফশোর ও অনশোর মিলে ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন বসানোর কাজ করছে। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশে পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার স্থলভাগের পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমানে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। মহেশখালীর মাতারবাড়ী থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ–পশ্চিম গভীর সমুদ্রে মুরিং পয়েন্টটি অবস্থিত। এই পয়েন্টে জ্বালানি তেল বোঝাই মাদার ভ্যাসেল বার্থিং নিয়ে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল খালাস করবে। মুরিং পয়েন্ট থেকে পাইপলাইনে তেল আসবে মহেশখালীর কালারামছড়া স্টোরেজ ট্যাংকে। সেখান থেকে পাম্প স্টেশনের মাধ্যমে পাম্প করে পাইপের মাধ্যমে তেল পাঠানো হবে ইস্টার্ন রিফাইনারির শোধনাগারে। এর একটি পাইপলাইন দিয়ে ক্রুড অয়েল, অপর লাইন দিয়ে রিফাইনড অয়েল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পৌঁছানো হবে। এই প্রক্রিয়ায় ৪৮ ঘণ্টায় ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল খালাস করা যাবে। এর বার্ষিক খালাসের ক্ষমতা হবে ৯০ লাখ মেট্রিক টন।
শুরুতে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মূল অনুমোদিত প্রকল্পটিতে ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির কাজ সময়মতো শুরু করতে না পারায় দিনে দিনে প্রকল্প ব্যয় বাড়তে থাকে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় বেড়ে ৭ হাজার ১২৪ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা হয়েছে।
প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন হলেও তৎপরতা শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২০১৮ সালের জুনে প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এরপর প্রতি বছর ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের জুনে প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তা–ও হয়নি। এখন আগামী তিন মাসের মধ্যে সাগর থেকে পাইপলাইনে তেল পৌঁছাবে চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোতে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইতোমধ্যে মহেশখালী এলাকায় ৯০ একর জায়গায় ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক ও পাম্প স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংকের তিনটিতে পরিশোধিত, বাকি তিনটিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুত করা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার এবং অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার।
এই প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেল খালাস শুরু হলে বিপিসির বছরে অন্তত ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনাকালসহ নানা প্রতিকূলতায় নির্ধারিত সময়ে কাজটি শেষ করা যায়নি। এতে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। প্রকল্পটি চালু হলে দেশের জ্বালানি তেল পরিবহনে বড় পরিবর্তন আসবে বলে জানান তিনি।