পাঁচ কারণে আলোচনায় চকবাজার উপ-নির্বাচন

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ হলেও পাঁচ কারণে নগরজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) চকবাজার উপ-নির্বাচন। কারণগুলো হচ্ছে- ভোটার উপস্থিত কম, প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ, বিজয়ীসহ সব প্রার্থীর জামানত হারানো, বিজয়ী প্রার্থীর অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একক কোনো প্রার্থী না থাকা। এই পাঁচ কারণ নিয়ে গতকালও দিনভর শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকও সরগরম ছিল বিষয়টি নিয়ে।
গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল চসিক নির্বাচন। এতে দুই হাজার ৭৫৫ ভোট পেয়ে চকবাজার ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন সাইয়্যেদ গোলাম হায়দার মিন্টু। তিনি মারা যাওয়ায় গত বৃহষ্পতিবার অনুষ্ঠিত হয় উপ-নির্বাচন। মাত্র ৭৮৯ ভোট পেয়ে এবার বিজয়ী হন নূর মোস্তফা টিনু। তার প্রদত্ত ভোট ওয়ার্ডটির মোট ভোটারের মাত্র দুই দশমিক ৪২ শতাংশ! এত কম ভোট পেয়ে টিনুর কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় নানাজন নানা মন্তব্য করছেন।
চকবাজার ওয়ার্ডে মোট ভোটার ৩২ হাজার ৪১ জন। উপ-নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৬ হাহার ৯৩২ জন। যা মোট ভোটারের ২১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ অবস্থায় ভোটারদের কেন্দ্রমুখি না হওয়া নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। কারো প্রশ্ন, নাগরিক অধিকার ভোট প্রদানের প্রতি ভোটারদের আস্থা কি কমে যাচ্ছে?
বিগত সময়ে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে অভিযোগ পাওয়া যেত, ‘কেন্দ্রে যাওয়ার সময় ভোটারদের পথে পথে বাধা দেয়া হয়েছে। প্রার্থীর এজেন্ট বা মনোনীত প্রার্থীর লোকজন জোর করে ভোট দিয়ে ফেলেছেন’। কিন্তু চকবাজার উপ-নির্বাচনে এমন অভিযোগ তেমন পাওয়া যায়নি। ভোটের দিন পরিবেশও ছিল শান্ত। এরপরও ভোটারদের কেন্দ্রমুখি না হওয়া নিয়ে ভাবাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, অতীতে নানা কারণে ভোটের প্রতি যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা ফিরে পাননি ভোটাররা। বিজয়ী নূর মোস্তফা টিনুর অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ‘কিশোর গ্যাং লিডার’ তকমাও আছে তার বিরুদ্ধে। যুবলীগের কোনো পদে না থাকলেও নিজেকে যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃক্সখলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছিলেন, নগরীর চকবাজার, বাকলিয়া ও পাঁচলাইশ এলাকায় ‘কিশোর অপরাধী চক্র’র নেতা টিনু। ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কাপাসগোলা এলাকার বাসা থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। সে মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়। পরে জামিনে বের হলেও গত জুন মাসে তাকে ফের কারাগারে পাঠানো হয়। এরপরও তাকে ভোটাররা কেন বেছে নিয়েছেন সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি।
অবশ্য একপক্ষ বলছেন, ভোটের দিন প্রার্থী বা ভোটারের পক্ষে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ উঠেনি। অর্থাৎ ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেক্ষেত্রে তার বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুয়োগ নাই। তাদের দাবি, ভোটাররাই তাদের জনপ্রতিনিধি বেছে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, নূর মোস্তফা টিনুর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. আবদুর রউফের বিরুদ্ধেও কিশোর গ্যাং লিডার তকমা আছে। টিনু শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও রউফ নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের অনুসারি বলে পরিচিত। যদিও নওফেল-নাছির প্রকাশ্যে তাদের কর্মী বলে টিনু-রউকে স্বীকার করতে দেখা যায়নি। তবে উপ-নির্বাচন ঘিরে নওফেল ও নাছির বলয়ের অনেককেই টিনু ও রউফের পক্ষে মাঠে সক্রিয় ছিলেন।
এ বিষয়ে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর মু. সিকান্দর খান দৈনিক আজাদীকে বলেন, যিনি বিজয়ী হয়েছেন এবং যিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দু’জনের নামেই বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় নেতিবাচক সংবাদ পড়েছি। এখন প্রশ্ন তারা কিভাবে ভোট পেয়েছেন। এক্ষেত্রে মনে হয়, ভোট দিতে যারা গেছেন তারা যে কোনো কারণে প্রার্থীর প্রতি কমিটেড ছিলেন। যারা কমিটেড তাদের চিন্তাটা হয়তো এমন, কি হবে না হবে সেটা ব্যাপার না। আমার অমুককে ভোট দিতে হবে। তিনি বলেন, যারা কমিটেডে ছিলেন না তারা ভোট দিতে যান নি। গেলে হয়তো ফলাফল এমন নাও হতে পারতো। যারা ভোট দিতে যায়নি তারা হয়তো মনে করেনি, ভোট দেয়ার মতো নিরাপদ পরিবেশ নাই। তা না হলে ৭৮ শতাংশের বেশি ভোট দিতে যাননি কেন?
এদিকে টিনুসহ সব প্রার্থীর জামানত হারানোর ঘটনাকেও নজিরবিহীন বলা হচ্ছে। সেটা নিয়েও চলছে আলোচনা। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) নির্বাচনী বিধিমালা ২০১০ এর ৪৪ নং ধারায় বলা আছে, ‘কোনো প্রার্থী নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের এক অষ্টমাংশ অপেক্ষা কম ভোট পেলে তার জামানতের টাকা সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে’। এ বিধি অনুযায়ী, চকবাজার উপ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের এক অষ্টমাংশ হচ্ছে ৮৬৬ ভোট। অর্থাৎ জামানত ফেরত পাওয়ার জন্য প্রার্থীকে ৮৬৬ ভোট পেতে হবে। কিন্তু বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, টিনুসহ কোনো প্রার্থীই এক অষ্টমাংশ ভোট পান নি। ফলে জামানাত বাজেয়াপ্ত হয়েছে সবার। উপ-নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন ২১ জন। এদের ২০ জনই আওয়ামী ঘরানার। যদিও আওয়ামী লীগ কাউকেই একক প্রার্থী ঘোষণা করেনি। বিষয়টি নিয়ে আছে নানা সমালোচনা। যেখানে সারা দেশে সাংগঠনিক শৃক্সখলা আনয়নের চেষ্টা চলছে সেখানে একটি ওয়ার্ডে একক প্রার্থী বাছাই করতে না পারা নিয়ে নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের দোষারোপ করছে তৃণমূল।
সামগ্রিক বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ৩২ হাজার ৪১ ভোটের মধ্যে যদি মাত্র ৭৮৯ ভোট পেয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তাহলে বুঝা যায়, ভোটের প্রতি মানুষের অনাস্থা, অনীহা, অবিশ্বাস কতটা বেড়েছে। সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকে। সে জায়গায় চকবাজার উপ-নির্বাচনে ভোটের যে চিত্র তা সত্যিই দু:খজনক। এটা গণতন্ত্রের জন্য খুব অশনি সংকেত। এজন্য আমরা শঙ্কিত ও আতংকিত। তিনি বলেন, নির্বাচন কশিমন, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং সর্বোপরি সরকারের এ বিষয়ে টনক নড়া উচিত। নির্বাচন কি উঠে যাচ্ছে?
বিজয়ী কাউন্সিলর প্রার্থী সম্পর্কে বলেন, ওনাকে নিয়ে অনেক জনশ্রুতি আছে। তারপরও আমরা আশা করবো ওনি জনস্বার্থে কাজ করে নিজের সুনাম বৃদ্ধি করবেন। পৃথিবীত মানুষই নিজের পরিবর্তন বেশি করতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল-আকসায় ইহুদিদেরও প্রার্থনার অনুমতি, মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ
পরবর্তী নিবন্ধজাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি আজ