পশু কেনায় প্রতিযোগিতা নয়, আসুন মানবিক হই

আ ব ম খোরশিদ আলম খান | মঙ্গলবার , ২০ জুলাই, ২০২১ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

‘কোরবানিতে বেশি দামে গরু কিনবেন? একটু ভাবুন’- এই শিরোনামে গত ১ জুলাই (২০২১) চট্টগ্রামের পাঠকধন্য দৈনিক আজাদীর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মালেকের লেখাটি যারাই পড়েছেন তারা সত্যিই কোরবানি নিয়ে নতুন করে ভাববেন নিঃসন্দেহে। আজাদীর সম্পাদক মহোদয় সভা সম্মেলনে ভালো বক্তৃতা দেন। শ্রোতারা পিন পতন নীরবতায় তাঁর বক্তৃতা শোনেন। তিনি আগে তেমন লিখতেন না। তবে করোনাকালে তিনি এখন নিজ নামে মাঝে মধ্যে নানা বিষয়ে আজাদীতে লিখছেন। বিভিন্ন বিষয়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। কোরবানি নিয়ে আজাদী সম্পাদক যা লিখলেন তা অনেকেরই মনের কথা। অত্যন্ত যৌক্তিক সময়োপযোগী ভাবনাই তিনি সাদাসিধে বর্ণনায় তুলে ধরেছেন। আসলে আমাদের দেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষ নানা উপলক্ষে খরচাপাতি একটু বেশি করতে অভ্যস্ত। কোরবানি, বিয়ে-শাদী, মেজবানসহ নানা সামাজিক ও ধর্মীয় উপলক্ষে চট্টগ্রামের মানুষ একটু বেশি খরচ করে বলা যায়। যা অনেকটা সীমালংঘন ও বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে বললেও অত্যুক্তি হবে না। আসলে নানা উপলক্ষে আচার-অনুষ্ঠান ঘিরে আমরা যা খরচাপাতি করি তা অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য। যেমন বিয়ে-শাদীতে ভোজন উৎসবের নামে ৫/৭ পদের বাহারি আইটেমে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়। অথচ তার আশপাশের এমন অনেক গরিব পরিবার আছে দুবেলা খাবার জোগাতেও হিমশিম খায়। টাকার অভাবে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে না পারা এমন গরিব নিঃস্ব পরিবারের সংখ্যা আমাদের চারপাশে নিতান্ত কম নয়। কঠিন পীড়ায় ও রোগে শোকে ভুগছে অথচ সীমাহীন দারিদ্র্যের কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাও অনেকে পায় না। আরো পীড়াদায়ক যে, বর্তমানে জীবনধারণ অনুপযোগী সামান্য বেতনের কারণে অনেকের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। আমাদের দেশে সর্বপর্যায়ের চাকরির ক্ষেত্রে শ্রম শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে। ফলে চাকরিনির্ভর পরিবারগুলোতে দুঃখ-দুর্দশা যেন কিছুতেই থামে না। অথচ সমাজের সৌভাগ্যবান বিত্তবান জনগোষ্ঠীর এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার কোনো গরজবোধ লক্ষ্য করা যায় না। ধনীরা গরিবের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হলে দেশের বিদ্যমান দারিদ্র্য পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে নিঃসন্দেহে।
আজাদীর বিজ্ঞ সম্পাদক মহোদয় চলমান কোরবানি কালচার নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনার কথা বলেছেন । ৫, ৭, ১০, ২০ লাখ টাকা দামের পশু কোরবানি প্রতিযোগিতায় না নেমে উক্ত টাকা বাঁচিয়ে ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় অনুদান প্রদান, এতিমখানার জন্য দান করা কিংবা কোনো টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে আর্থিক অনুদান প্রদানে তিনি সচ্ছল কোরবানিদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর কথায় যুক্তি আছে। আছে দূরদর্শিতা, গঠনমূলক চিন্তা, বিবেচনাবোধ ও মানবিকতা। তিনি বলেছেন অপ্রয়োজনীয় খরচ বাঁচিয়ে বেশি টাকায় কোরবানি পশু না কিনে কোনো টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে যন্ত্রপাতি কেনায় আর্থিক অনুদান দেয়া হয় তাহলে সেখান থেকে কম খরচায় দক্ষ শিক্ষার্থী ও জনবল তৈরি হবে। এতে একেকটি পরিবারে উপার্জনের পথ বেরিয়ে আসবে। একে একে বহু পরিবার হবে স্বনির্ভর-আজাদী সম্পাদকের এ প্রত্যাশার সাথে আশা করি দ্বিমতের অবকাশ নেই। তিনি বলেছেন- ‘কোরবানির জন্য একটি সুন্দর নিখুঁত পশু কিনতে খুব বেশি টাকার প্রয়োজন নেই। আপনি যদি লাখ টাকার গরু কেনার বাজেট করে থাকেন একটু চিন্তা করে দেখুন এক বা দুই লাখ টাকা দিয়ে একটা সুন্দর সুস্থ গরু কিনে আল্লাহর নামে কোরবানি করে বাকি টাকাটা ক্যান্সার হাসপাতাল বা এতিমখানায় দান হিসেবে দেওয়া যায় কিনা। আবার আপনার পাড়া বা মহল্লায় কোনো প্রতিবেশী ছাত্র-ছাত্রী যদি টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে না পারে আপনি এ টাকা দিয়ে তাদের লেখাপড়ার পথও সুগম করে দিতে পারেন।’ পরিশেষে সম্পাদক মহোদয় বলেছেন যারা বেশি বাজেটের কোরবানি করার কথা চিন্তা করছেন তারা একটু ভেবে দেখবেন, একটি পশু কোরবানি দিয়ে শেষ করবেন নাকি সদকায়ে জারিয়া (প্রবহমান পুণ্য) ব্যবস্থা করবেন? কী মানবদরদী আহ্বান! জনাব এম এ মালেকের এ বক্তব্য ও নির্দেশনা অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। এ ধরনের সুন্দর যৌক্তিক ও মানবিক কথা বলার লোকও দিনদিন আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই আচার সর্বস্ব প্রথা নির্ভর হয়ে পড়ছি। অথচ প্রতিটি ধর্মের সারবত্তা ও নির্দেশনাই হলো মানুষ, মানবতা ও মানবকল্যাণ। যেমন কোরবানি হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশে তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে সঁপে দেওয়া। আত্মত্যাগই হচ্ছে কোরবানির অন্তর্নিহিত শিক্ষা। যারা সারা বছর অর্থকষ্ট ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মাংস কিনে খেতে পারে না তারা কোরবানির ওসিলায় তৃপ্তিসহ মাংস খাওয়ার সুযোগ পান।
কোরবানির মতো ইসলামী বিধান তথা ধর্মীয় আয়োজনেও মানুষ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তুলে আনা হয়েছে। তাদের অধিকার সমুন্নত করা হয়েছে। একদিকে আল্লাহর নির্দেশ পালন এবং অন্যদিকে গরিব বঞ্চিত মানুষকে হাসিখুশিতে রাখাই হচ্ছে কোরবানির অন্তর্নিহিত দর্শন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা কে কতো বড় কোরবানি দিয়েছো তা আল্লাহ পাক দেখেন না। তিনি দেখেন তোমাদের ভেতরের নিয়ত ও তাকওয়া। তাই আসুন লাখ লাখ টাকা দামের পশু কোরবানি কেনায় প্রতিযোগিতায় না নেমে উক্ত খরচ বাঁচিয়ে আর্ত পীড়িত দুস্থ বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াই। অপ্রয়োজনীয় খরচ বাঁচিয়ে এবং বিলাসিতা কমিয়ে আপনার চারপাশের অভাবী দরিদ্র অসহায় মানুষের সেবা ও কল্যাণে এগিয়ে আসুন। তাদের প্রয়োজন পূরণ করুন। তাদের দুঃখ কষ্ট জীবনের গ্লানি মোচন করুন। একটি সুন্দর মানবিক ও বঞ্চনামুক্ত দেশ ও বিশ্ব গড়ায় আপনিও শামিল হোন।
পরিশেষে অত্যন্ত যৌক্তিক, মানবিক, মৌলিক চিন্তাধর্মী ও সময়োপযোগী আহ্বানের জন্য বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব আজাদী সম্পাদক জনাব এম এ মালেকের প্রতি অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আজাদী যে গণ মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক তা উক্ত লেখার মধ্য দিয়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এ ধরনের কীর্তিমান ব্যক্তির কাছ থেকে আগামী দিনেও দিক নির্দেশনামূলক আরো লেখা আমরা আশা করি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যবিধি মেনেই উপভোগ্য হোক ঈদ আনন্দ
পরবর্তী নিবন্ধকুরবানী ও আমাদের করণীয়