কুরবানী ও আমাদের করণীয়

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | মঙ্গলবার , ২০ জুলাই, ২০২১ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

কুরবানি-এটির আরবী প্রতিশব্দ উদহিয়্যাহ। কুরবানির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমাদেরকে অনেক পেছনে ফিরে যেতে হবে। মানব সৃষ্টির ইতিহাস যতই প্রাচীন, কুরবানির ইতিহাস ততই প্রাচীন। আল্লাহতায়ালা আমাদের বিশ্বনবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে রাসূল (সা.) আপনি লোকদের সামনে সত্যতার সাথে হযরত আদম (আ.) এর দু’সন্তানের ইতিহাস তুলে ধরুন যখন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী পেশ করল, তখন তাদের মধ্যে একজনের কাছ থেকে কুরবানি কবুল করা হল, আরেকজনের কাছ থেকে কবুলই করা হল না, (যার কুরবানী কবুল করা হয়নি) সে (কাবিল) বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব, (যার কুরবানী কবুল করা হল), সে (হাবিল) বলল, আল্লাহতায়ালা শুধু মোত্তাকীদের কাছ থেকেই (কুরবানী) কবুল করেন’-সূরা মায়েদা ২৭। তাঁর দু’সন্তানকে কুরবানী করার জন্যে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশ এসেছিল। হাবিল উৎকৃষ্ট মানের একটি পশু পাহাড়ের চূড়ায় রেখে এসেছিল আর কাবিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের শস্যদানা আল্লাহতায়ালার জন্যে উৎসর্গ করেছিল। এতে বুঝা যায়, কাবিল এর কুরবানীর মধ্যে নিষ্ঠা বা তাকওয়া ছিল না। এ জন্যে তার কুরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়নি আর হাবিল এর কুরবানী আল্লাহপাক কবুল করেছিলেন। মানবতার প্রথম ইতিহাস থেকেই কুরবানীর এই ধারা প্রবর্তন হয়ে আসছে, যদিও কুরবানীর ধারার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। পশু জবাইয়ের মাধ্যমে কুরবানী করা-প্রথাটি প্রবর্তিত হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর আমলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর এভাবে প্রত্যেক জাতির জন্যে আমি (পশু) কুরবানীর এ নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে করে (সেই) লোকেরা সেসব পশুর উপর আল্লাহতায়ালার নাম নিতে পারে, যা তিনি তাদের দান করেছেন’-সূরা হজ্জ-৩৪। আমাদের প্রাণপ্রিয় বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর যুগে কুরবানী প্রবর্তিত হয়েছিল হিজরী তৃতীয় সনে, যে সময় সা’লাতুল ঈদ ও যাকাত প্রবর্তন বা ফরজ করা হয়েছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন ইরাকে বসবাস করতেন তখন আল্লাহতায়ালার একাত্তবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তৎকালীন বাদশা নমরুদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। এক পর্যায়ে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ইরাক ছেড়ে শাম দেশ বা বর্তমান ফিলিস্তিন-এ হিজরত করেন। যখন হযরত ইব্রাহীম ইরাক ছেড়ে ফিলিস্তিনে হিজরত করার জন্যে আসলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমাকে একটি নেক সন্তান দান কর, যে সন্তান আমাকে ইসলাম প্রচারে সহযোগিতা করবে, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আমার সহযোগী হবে এবং প্রবাসে আমার সাথী হবে’। আল্লাহ সুবহানাতায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করলেন এবং হযরত ইব্রাহীমকে ৮৬ বছর বয়সে একটি সন্তান দান করলেন যার নাম ছিল ইসমাঈল। মহান আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহীমকে আরো একটি সন্তান দান করেছেন যার নাম ছিল হযরত ইসহাক (আ.)। কোন কোন কিতাবে রেওয়ায়েত আছে যে, হযরত ইব্রাহীম আল্লাহতায়ালার জন্যে ১ হাজার ছাগল বা বকরি, ৩ শত গাভী ও ২ শত উট কুরবানী করেছিলেন। তাঁর এই কুরবানীর দৃশ্য দেখে মানুষেরা ও ফেরেশতারা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত ইব্রাহীম বলেন, আমি আল্লাহর পথে যা কিছু কুরবানী করেছি তা আমার কাছে কিছুই না, এমন কি আমার যদি একটি সন্তান থাকত তাকেও আমি আল্লাহর জন্যে কুরবানী করতাম বা জবাই করে দিতাম-সুবাহানআল্লাহ। এ কথার বলার অনেক পরে যখন তিনি তা ভুলে গিয়েছিলেন তখন আল্লাহতায়ালা তাঁকে একটি সন্তান দান করলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তাঁকে স্বপ্নে দেখালেন যে, তুমি তোমার মানত পূর্ণ কর। তিনি ওদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চিন্তা করতে লাগলেন-এই স্বপ্ন কি আল্লাহতায়ালা দেখিয়েছেন? নাকি শয়তান দেখিয়েছেন? দিনটি ছিল জিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখ, যেটিকে বলা হয় চিন্তাভাবনার দিন। এর পরের রজনীতে আবারও স্বপ্ন দেখানো হল। তখন তিনি বুঝতে পারলেন এই বিধান বা এই নির্দেশ আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে। দিনটিকে বলা হয় ইয়ামুল আরাফা বা আরাফাতের দিন, যা ছিল জিলহজ্ব মাসের নবম তারিখ। এরপরের দিন তিনি কুরবানি করেছিলেন। দিনটিকে বলা হয় ইয়ামুন নাহার। হযরত ইব্রাহীম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হলেন নিজের সন্তানকে কুরবানী করার জন্যে- তিনি নিজের কলিজার টুকরো সন্তানকে নিয়ে কুরবানী করতে গিয়েছিলেন-নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ, প্রিয় জিনিস কুরবানী করার জন্য উদ্যত হলেন, তিনি আল্লাহর বিধান বা নির্দেশ পালন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।
ইসমাঈলের বয়স যখন ৭ কিংবা ১২ বছর তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁকে কুরবানী করার জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে। তিনি তার স্বীয় পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আমার সন্তান-আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমাকে কুরবানি করছি, এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? শিশুটি সাথে সাথে ঈমানদৃপ্ত কন্ঠে তাঁর বাবাকে বললেন, বাবা তুমি সেটাই কর যা তোমাকে আদেশ করা হয়েছে। আমাকে তুমি পাবে ধৈর্যশীলদের সাথে আর আল্লাহতায়ালার নির্দেশ আমি মাথা পেতে নিয়েছি। আমি এ আদেশ পালন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করব’। শিশু ইসমাঈল তাঁর পিতা হযরত ইব্রাহীমকে বলেন, বাবা আমাকে জবাই করার সময় আমার হাত-পাগুলো ভালোভাবে বেঁধে রাখবে যেন আমি তোমাকে কষ্ট না দিই। তুমি তোমার দৃষ্টি আমার দিকে না দিয়ে মাটির দিকে নিবদ্ধ করবে, যাতে করে তোমার চোখের উপর আমার চোখ পড়ে না যায়। তোমার চোখ যদি আমার চোখে পড়ে যায় তবে তোমার মায়া লাগবে-তুমি ধৈর্য ধারণ করতে পারবে না তুমি দূর্বল হয়ে যেত পার’। বাবা আমাকে যখন তুমি কুরবানি করবে তোমার জামা কাপড়গুলো ভালো করে গুটিয়ে নিও। হতে পারে আমার রক্ত ছিঁটকে পড়ে তোমার কাপড়ে লেগে যেতে পারে। এই রক্তাক্ত পোশাক দেখে আমার মা চিন্তিত হয়ে যেতে পারে, তুমি যে ছুরি দিয়ে জবাই করবে তা ভালো করে ধারালো করে নিও। যখন তুমি জবাই করবে তখন খুব দ্রুত ছুরিটা চালাবে। মৃত্যু বড়ই কঠিন-তাহলে আমার মৃত্যুটা সহজ হবে। আমার এই রক্তাক্ত পোশাক আমার মাকে দিয়ে দিও। আমার পক্ষ থেকে আমার মায়ের জন্যে তা স্মৃতিস্বরুপ থাকবে। আমার মাকে সালাম বলবে, আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পালনার্থে যেন আমার মা ধৈর্য ধারণ করতে পারেন। আমার মাকে বলবে না-তুমি কিভাবে আমাকে জবাই করেছ, কিভাবে তুমি আমার হাত পা বেঁধেছিলে। আমার মৃত্যুর পরে আমার মার কাছে আমার সমবয়সী কোন শিশুকে নিয়ে যেও না। তাহলে আমার মায়ের কষ্ট আরো বেড়ে যেতে পারে। পিতার কাছে অনেকগুলো অনুরোধ করার পর যখন পিতা-পুত্র আল্লাহর বিধানের সামনে মাথা নত করলেন আর বাবা যখন পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন আর সন্তান জবাই হওয়ার জন্য মাথা পেতে দিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) যতই ছুরি চালাচ্ছেন ইসমাঈলের ঘাড় কাটা তো দূরের কথা একটি পশমও কাটছে না।
ইসমাঈল বললেন, বাবা তুমি আমার হাত-পায়ের বাঁধনগুলো খুলে দাও কারণ হাত পা বাঁধা অবস্থায় কুরবানী করছ-এই দৃশ্য আল্লাহর ফেরেশতারা দেখছেন তারা হয়তো মনে করতে পারে আমি আল্লাহর বিধান স্বেচ্ছায় মাথা পেতে নিইনি। আমাকে জোর করে আল্লাহর বিধান মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমি তো আল্লাহর বিধান স্বেচ্ছায় মাথা পেতে নিয়েছি। তুমি আমার বাঁধনগুলো খুলে দাও বাবা। বাঁধন খুলে দেওয়া হল-আবার তিনি ছুরি চালাচ্ছেন। এবারও যখন ছুরি একটা পশমও কাটছে না তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) ক্ষুদ্ধ হয়ে ছুরিটি ছুঁড়ে মারলেন আর ছুরিটি একটি পাথর খন্ডকে আঘাত করল, পাথরটি দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। তখন ইব্রাহীম বলছিলেন, তুমি কেমন ছুরি-তুমি বিশাল পাথর দ্বিখন্ডিত করে দিতে পার কিন্তু নরম গোশতের টুকরা কাটতে পার না-তুমি কেমন একটা উদ্ভট ছুরি। ছুরিকে আল্লাহতায়ালা বাকশক্তি দিয়েছিলেন। তখন ছুরি বলছিল, ‘ইব্রাহীম তুমি বলছ কাট আর মহাবিশ্বের মহাশক্তিধর আল্লাহতায়ালা বলছেন, ছুরি তুমি কাটবে না। তাহলে বল-ইব্রাহীম আমি আল্লাহর নির্দেশ লংঘন করে কিভাবে তোমার কথা মেনে নিই-সুবহানাল্লাহ। আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘পিতা-পুত্র যখন নিরংকুশভাবে আমার বিধান মাথা পেতে নিল তখন আমি ডাক দিয়ে বললাম, ইব্রাহীম আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি-তুমি আমার বিধান বাস্তবায়ন করে ফেলেছ। এভাবে আমি সৎকর্মশীলদের উত্তম প্রতিদান দিয়ে থাকি’। যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) ইসমাঈলের গলায় ছুরি চালাচ্ছিলেন তখন আল্লাহতায়ালা হযরত জিবরাইলের মাধ্যমে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন, যে দুম্বাটি হযরত আদমপুত্র হাবিল কুরবানী করেছিলেন-সেই দুম্বাটি আল্লাহতায়ালা সংরক্ষণ করেছিলেন। সেই দুম্বাটি ইসমাঈলের পরিবর্তে জবাই হয়ে গেল। আমি ইসমাঈলের পরিবর্তে এই পশুটি ফিদিয়াস্বরূপ পাঠিয়ে দিলাম। তখন থেকেই পশু কুরবানীর ধারাটি চালু হয়ে গেল। আল্লাহতায়ালা কুরআনুল করিমে বলছেন, ‘তুমি বলো, অবশ্যই আমার নামায, আমার (আনুষ্ঠানিক) কাজকর্ম, আমার কুরবানী, আমার মৃত্যু-সবকিছুই সৃষ্টিকূলের মালিক আল্লাহতায়ালার জন্যে’-সূরা আল্‌ আনয়াম-১৬২।
লেখক: সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)

পূর্ববর্তী নিবন্ধপশু কেনায় প্রতিযোগিতা নয়, আসুন মানবিক হই
পরবর্তী নিবন্ধঈদুল আজহা আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর