নাগরিক দুর্ভোগমুক্ত এবং সর্বসাধারণের সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলাই আমার স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নপূরণে যে আর্থিক সক্ষমতা দরকার তা নেই। আমি সীমিত সময়ের জন্য প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি বিশাল অংকের দেনার বোঝা নিয়ে। নগরীর বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি এবং যেগুলোর জরুরি ভিত্তিতে নিরসন প্রয়োজন সে জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি। পরামর্শক কমিটির কাছে যে পরামর্শগুলো পেয়েছি সেগুলো যৌক্তিক, কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। তবে আগামীতে চসিকের নির্বাচিত পরিষদ চট্টগ্রামকে যেন বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করতে পারে সেজন্য কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার তার একটি ধারণা আমি রেখে যেতে চাই।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরামর্শক কমিটির সাথে ভার্চ্যুয়াল সভা গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের সেবামূলক কার্যক্রম চলমান রাখতে সরকারের কাছে বরাদ্দ চেয়েছি। কিছু থোক বরাদ্দ পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি সেবাসংস্থা বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। তারা তাদের ভারী যানবাহন ও কন্টেইনারগুলো চসিকের রাস্তাগুলো ব্যবহার করে। এই রাস্তাগুলোর উপর ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত কয়েক গুণ বেশি মালামাল পরিবহনের গাড়িগুলোর কারণেই এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্দরের মোট আয় থেকে শতকরা ১ অংশ সার্ভিস চার্জ চেয়েছি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ল্যান্ডিং অবস্থান এই নগরীতে। এ কারণে তাদের কাছ থেকেও সার্ভিস চার্জ চসিক পেতে পারে। ইপিজেড হোল্ডিং ট্যাঙ না দিলেও সার্ভিস চার্জ অবশ্যই দেওয়া দরকার। ভারী শিল্প, বিশেষ করে ইস্পাত কারখানাগুলোর ভারী যানবাহন এই নগরের রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। তাই রাস্তাঘাট নষ্ট হয়। তাদের ভারী যানবাহনগুলো অবৈধভাবে সড়কের উপর পার্কিং করেন। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী বন্দরের কোনো পরিবহন টার্মিনাল নগরীর ২০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে পারে না। কিন্তু বন্দরের আশেপাশে অন্তত ২০টি স্পটে তাদের কন্টেইনার স্ট্যান্ড রয়েছে। ফলে সী-বিচের পর্যটন স্পটে যাওয়াটা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে।
প্রশাসক বলেন, সরকারি সেবাসংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন ধার্যকৃত করের তালিকা দিয়েছি। আশা করি তারা চসিকের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি আমলে আনবে।
তিনি বলেন, শিক্ষাখাতে বড় অংকের ভর্তুকি দিতে হয়। একইভাবে স্বাস্থ্যখাতকেও দিতে হচ্ছে। নগরীতে সরকারি সেবা সংস্থার মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে। এই কাজের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে এবং নাগরিক দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে সমন্বয় দরকার। ওয়াসাকে বলেছি, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির আগে সিটি কর্পোরেশনকে জানাতে হবে। কিন্তু তারা আমাদের অনুরোধ আমলে আনে না। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
চট্টগ্রামে খেলার মাঠের অভাবের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সন্তানরা খেলাধুলা করতে পারে এমন কয়েকটা মাঠ দরকার। বাকলিয়ায় যে স্টেডিয়াম আছে সেখানে একটি ক্রিকেট একাডেমি করে দিলে ভালো হয়। আউটার স্টেডিয়াম খেলাধুলার উপযোগী করা হয়েছে। তবে অপরিকল্পিত সুইমিং স্টেডিয়ামের কারণে এই মাঠের একটি বড় অংশ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আগ্রাবাদ জাম্বুরী মাঠে একটি শিশু পার্ক করা হয়েছে। এই পার্কের অধীনে বিস্তর জায়গা অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এখানে যে বিনোদন কেন্দ্রটি আছে এটি আকর্ষণীয় নয়। এটাকে আরো আকর্ষণীয় করতে খেলার মাঠসহ একটি অত্যাধুনিক ক্রীড়া কমপ্লেঙ চাই। নগরীতে কোথাও মার্কেট তৈরি করতে হলে আগে চসিকের অনুমতি নিতে হবে বলে জানান তিনি।
সভায় ব্র্যাকের সিনিয়র অ্যাডভাইজার মো. আবদুল করিম বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন পদে বর্তমানে চট্টগ্রামের সন্তানরা দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক সাবেক কর্মকর্তাও দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বর্তমান মুখ্য সচিব চট্টগ্রামের সন্তান। সবাইকে একসাথে নিয়ে ঢাকায় একটি সভা করা দরকার। এখান থেকে চট্টগ্রামের স্বার্থে অনেক সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সমন্বয়ের জন্য দরকার একজন মুখ্য কান্ডারী। এখানে নগর সরকারের কথা উঠেছে। ১৯৮২ সালে সিটি কর্পোরেশন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন না হলে নগর সরকার বাস্তবায়ন হবে না। সিটি কর্পোশেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। তবে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য নগরবাসী ট্যাঙ দেয় না। এজন্য চট্টগ্রামের শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি বৈঠক করা দরকার এবং এই বৈঠক থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত বের করতে হবে।
দৈনিক পূর্বকোণের সম্পাদক ডা. রমিজ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, চসিকের মূল সেবাগুলো নগরবাসী পাচ্ছে কিনা এবং বাড়তি কী পাওয়া উচিত তা আমাদের ভাবতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের লোকসংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। কিন্তু জনবল বাড়েনি, তহবিলও বাড়েনি। তাই লোকবল ও আর্থিক সামর্থ্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। প্রত্যেক দেশে একটি লবিং গ্রুপ থাকে। সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে অধিকার আদায়ের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেরও একটি লবিং গ্রুপ থাকা দরকার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য কমডোর জোবায়ের আহমদ বলেন, কর্ণফুলী বাঁচলে চট্টগ্রাম বাঁচবে, চট্টগ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। তাই আগে কর্ণফুলীকে বাঁচানোর জন্য নিয়মিত ও সঠিকভাবে ড্রেজিং দরকার। এতে স্বাভাবিকভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর টান্সশিপমেন্ট ও একটি ট্রান্সজিট কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে চট্টগ্রামের সড়কগুলো দিয়ে ভারতের সাতটি রাজ্য এবং নেপাল ও ভুটানে ভারী পরিবহন চলাচল করবে। আমি দাবি করব, ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট থেকে দেশের যে আয় হবে তা থেকে একটি অংশ চসিকে দিতে হবে।
বিজিএমইএর ১ম সহ-সভাপতি এম এ সালাম বলেন, চট্টগ্রামে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, কিন্তু সমন্বয় নেই। তাই সমস্ত সেবামূলক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে একই ছাতার নিতে আসতে হবে।
সাবেক আইজিপি মো. নুরুল আলম বলেন, চসিককে বাঁচাতে হলে ঢাকা থেকেই দাবি তুলতে হবে। এজন্য লবিং গ্রুপ তৈরির প্রস্তাবটি সমর্থন করি।
শিক্ষাবিদ প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া বলেন, চসিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বন্ধ হয়ে না যায়। আমি আশা করব, যুগের চাহিদা অনুযায়ী চসিকের ভিত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান চালু হোক।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক আকরাম খান বলেন, বিশ বছর আগে ক্রিকেটসহ যেকোনো জাতীয় দলে চট্টগ্রাম থেকে ৭/৮ জন প্রতিনিধিত্ব করত। বর্তমানে জাতীয় ক্রিকেট দলে তামিম ছাড়া আর কেউ নেই। এর কারণ চট্টগ্রামে ক্রীড়া উপযোগী মাঠগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি জিনিস মনে রাখতে হবে, খেলাধুলার স্থান সংকীর্ণ হয়ে গেলে নতুন প্রজন্ম বিপথগামী হবে, মাদকাসক্ত হবে। প্রশাসক বাকলিয়া স্টেডিয়ামে ক্রিকেট একাডেমি করার কথা বলেছেন। আমি তার সাথে সহমত পোষণ করছি।
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, চট্টগ্রামে একটি ক্রিকেট একাডেমি হওয়া দরকার। তবে তার জন্য বড় পরিসর প্রয়োজন। আমি প্রস্তাব করছি নগরীর বাইরে বড় এলাকা নিয়ে ক্রিকেট একাডেমি গড়ে উঠুক। কর্পোরেশনে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা বাজেট থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি। চট্টগ্রামে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি রয়েছেন। তারা এগিয়ে এলে ফান্ডের সংকট কেটে যাবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সিডিএ ও ওয়াসার মতো চসিকেরও একটি মাস্টার প্ল্যান থাকা প্রয়োজন।
চসিক সচিব আবু সাহেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় আরো বক্তব্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান ও আইইবি চট্টগ্রামের সভাপতি প্রবীর কুমার সেন। উপস্থিত ছিলেন প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমেদ ও প্রশাসকের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম।