এক মাস রোজা পালন শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদ। রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ–তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলী দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারায় প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয়। এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র রেডিও–টেলিভিশন ও পাড়া–মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্তায় ‘ঈদ মোবারক’। সেই সঙ্গে চারদিকে শোনা যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রোজার ঈদের গান-‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ /তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’।
মানুষের বিভিন্ন অনৈতিক, আবেগতাড়িত ও অবিবেচনাপ্রসূত কার্যাবলীর কারণে অনেকের জীবনে গভীর অশান্তি নেমে আসে ঈদ যাত্রায়। মানুষ বাড়িতে যাওয়ার জন্য ঢাকাসহ বড় বড় সিটি থেকে গ্রামের বাড়িতে নাড়ীর টানে ছুটতে শুরু করে। আর এই ছোটা নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড। অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ বেড়ে যায় বহুগুণে। এমনিতেই বহুল জনসংখ্যার দেশে এই যাত্রা একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায় কারণ সাধারণ অবস্থাতেই আমাদের রাস্তাঘাটে জ্যাম লেগে থাকে। আর ঈদ এলে এই জ্যাম পুরোটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসব কাজে যারা নিয়োজিত থাকে তারা অনেক সময় ইচ্ছে করেই জ্যাম লাগিয়ে থাকে। মানুষকে কষ্ট দিতে পেরে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ তারা উপভোগ করে। যারা রাস্তাঘাট নির্বিঘ্ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত তারাও নিজ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না, কোন দায়বদ্ধতা নেই, কোন চাপ নেই, নৈতিক কোনো তাড়না নেই যে, তাদের এই পবিত্র দায়িত্ব সততার সাথে পালন করতে হবে। তাই প্রতিবছর আমরা দেখতে পাই যানবাহনের দীর্ঘ লাইন, এই লাইন ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ মাইল কিংবা তারও বেশি। প্রচণ্ড দাবদাহ, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে না পারাসহ বহু পেরেসানির মধ্যে ছটফট করতে থাকে ছোট শিশু ও নারী যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা, পুরো দিন ও রাত এমনকি ঈদের দিন বিকেলেও অনেকে বাসায় পৌঁছাতে পারে না। এত কষ্ট সহ্য করে যখন বাসায় পৌঁছে, সাথে সাথে চিন্তা কিভাবে আবার কর্মস্থলে আসবেন। এগুলোর জন্য আমরা নিজেদের ভাগ্যকেই দায়ী করি কারণ এগুলো দেখার কেউ কখনো ছিল না, এখনো নেই। তারপরেও দিন চলে যাচ্ছে, সমাজ চলছে, মানুষ তাঁর নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে, এই তো পৃথিবী, এই তো ধরনীর নিয়ম। একটি সুষ্ঠ, সুন্দর ও ন্যায়নীতি পরায়ণ সমাজে বাস করার আগ্রহ ও ইচ্ছে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে থাকলেও সে রকম প্রচেষ্টা অনেকেরই নেই। যে যার দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করলেই আমরা সমাজটাকে পাল্টে দিতে পারি।
এত ধর্ম কর্ম নিষ্ঠা, নামাজ দোয়া সবকিছু পালন করা সত্ত্বেও আমাদের মাঝে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা পায়নি। কেন? কী কারণে? অনেকগুলো প্রশ্নের সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
সর্বত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্থিরতা, ভয়, ভীতি, শঙ্কা ও ভবিষ্যতের প্রতি অনাস্থা। বৃদ্ধি পাচ্ছে শোষণ, নির্যাতন, অন্যায় ও অরাজকতা। মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস। বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকের ব্যবসা। মানুষ শান্তির অন্বেষায় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। মানুষকে শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কোন সমাজ, কোন সংগঠন, কোন রাষ্ট্র, এমন কি কোন ধর্ম। সর্বত্রই অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান।
দারুণ সংকটে কাটছে দিন। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা সকলের মধ্যে। একের পর এক খুন হচ্ছে মানুষ। পারিবারিক কলহে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের শিকার হচ্ছেন। ব্যক্তি স্বার্থ আর দ্বন্দ্বে সহোদর, নিকট আত্মীয়, বন্ধু, বান্ধবকেও খুন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণ কিংবা সন্ত্রাসী ঘটনায়ও মানুষ খুন হচ্ছে। প্রতিনিয়তই পত্রিকার পাতা খুললে খুনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষন্নতা, আর্থিক দৈন্যতা। ফলে সমাজে বেড়েই চলছে অপরাধ। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে শিশু সন্তানেরাও। পারিবারিক কলহ, রাজনৈতিক বিরোধ, পরকীয়া, ছিনতাইকারীর আক্রমণ ও পেশাদার অপরাধী গ্রুপের অভ্যন্তরীণ বিরোধে ঘটে চলছে খুনের ঘটনা।
যারা সমাজের নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করে আছেন তারা মিথ্যা অহমিকায় মিকি চাকচিক্যর মাঝে রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও ধোকাবাজি করে জনগণের রক্ত শোষণ করছে। যারা জ্ঞানের অলংকার নিয়ে সবজান্তার ভাব করে আছেন তাদের মাঝে সত্যিকার অর্থেই জ্ঞান বলতে কিছুই নেই। ফলে সমাজে আজ দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নৈতিকতাবোধের অভাব, চোরের হাতে গৃহ পাহারার দায়িত্ব পড়েছে। অযোগ্যরা যোগ্যতার আসন দখল করে সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে আছে। ফলে হাজার বছর পূর্বের সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অসভ্য সমাজ ব্যবস্থা পুনরায় যেন আমাদের কাঁধে এসে ভর করেছে।
মাছে ভাতে বাঙালির সে গ্রামবাংলার চিত্র আজ পাল্টে গেছে। গ্রামের জীবন কাঠামো বদলে গেছে অর্থনৈতিক বিবর্তনের কারণে। সুখে দুঃখে শান্তিতে বিপদে আপদে যারা একাত্ম হয়ে হেসে খেলে দিনাতিপাত করেছিল সেখানে আজ মানুষ মানুষকে খুন করছে, অপহরণ করছে, আপনজনের রক্তে রঞ্জিত সে সব গ্রামীণ সবুজাভ শিশির মাখা ঘাস। ঘর থেকে কিংবা পথ চলতে ধরে নিয়ে গ্রামের চপলা কিশোরীদেরকে ধর্ষণ করছে, ধর্ষণ করেও শান্তি নেই, ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে নির্মম পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেছে।
রাজনীতি কি শত বছর আগেও ছিল না? দলাদলি, পাল্টাপাল্টি তখনও ছিল এখনও আছে। টাউট বাটপার তখনও ছিল। এখন যে নারকীয় পরিবেশে আমরা বাস করছি তা অতীতে কখনও ছিল না। নিরাপত্তাহীনতা, ঝগড়া–ফ্যাসাদ এবং তার পরিণতিতে খুন–খারাবি, অপহরণ, জমজমাট মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, সংঘর্ষ, দলাদলি, গোপন হত্যা, চাঁদাবাজি, ফলিত পণ্যের বাজারজাত করণের সমস্যা, ফড়িয়া দালাল কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ক্যাডারদের সর্বত্র নাকগলানোর স্বভাব। পরিবহণ সমস্যা, শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থা সর্বোপরি গ্রামবাংলার প্রতি নিদারুণ অবহেলা প্রভৃতি এখন সময়ের স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষ চারিত্রিক দিক দিয়ে কলুষতার নিম্নতম পর্যায়ে নেমে গেছে। যেসব গুণাবলি মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে তার চর্চা এখন নেই বললেই চলে। মানুষের এই ক্রমাবনতিকে ত্বরাম্বিত করছে নীতিহীনতা। যেসব রিপুর প্রাবল্যে মানুষকে অমানুষ করে তা ক্রমেই তীক্ষ্ণ ও তীব্র হচ্ছে। সমস্ত মূল্যবোধ প্রায় বিধ্বস্ত।
আজকে রমজানের শেষ প্রান্তে এসে অনেকগুলো প্রশ্ন আমাদের নৈতিকতাবোধকে ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। পবিত্র মাসে খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ‘পবিত্র রমজানে শয়তান গেছে ছুটিতে তার স্থান দখল করেছে ব্যবসায়ীরা’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক– শিল্পশৈলী।