ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর সাম্যের উৎসব

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

| মঙ্গলবার , ৯ এপ্রিল, ২০২৪ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য কুরআন সুন্নাহ কর্তৃক স্বীকৃত। ঈদ মানেই হচ্ছে খুশি, আনন্দ, উৎসব, ঈদুল ফিতর মুসলমানদের গৌরবময় সংস্কৃতি। শাওয়ালের ১ম তারিখে পশ্চিমাকাশে নবচন্দ্রের উপস্থিতি ঈদুল ফিতরের আগমনী বার্তা জানান দেয়। বিশ্ব মানবতার কান্ডারী মুক্তির দিশারী রাহমাতুল্লীল আলামীন কর্তৃক পবিত্র মদীনা নগরীতে উদ্ভাবিত সেই ঈদুল ফিতর আজ বিশ্বব্যাপী দুইশত কোটি মুসলমানদের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।

অন্য জাতির উৎসব ও মুসলমানদের আনন্দ উৎসব এক নয়: মুসলমানদের প্রতিটি কর্ম হতে হবে ইসলাম সম্মত। কুরআন সুন্নাহ কর্তৃক সমর্থিত। কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী আদর্শ ও চেতনা বিরোধী কোনো প্রকার অশ্লীল আনন্দ বিনোদন, ইসলাম অনুমোদন ও সমর্থন করেনা। সুতরাং এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের শ্লোগান “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এ জাতীয় বক্তব্য ও শ্লোগান ইসলাম সম্মত নয়। ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত মুসলমানদের আনন্দ উৎসব তাওহীদি চেতনায় উজ্জীবিত। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। হুব্বে রসূলের প্রেরণায় তেজোদীপ্ত।

মুসলমানদের চিন্তা চেতনা ও জীবনধারায় ঈদের মূল্যবোধ: ঈদ মুসলমানদের আক্বিদা বিশ্বাস ও একত্ববাদের চেতনায় হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। পবিত্রতা ও তাকওয়া ভিত্তিক জীবনাদর্শের অনুসরণই মুসলমানদের মুক্তির পাথেয়। খলিফাতু রাসুলিল্লাহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে নবীজি এ কারণেই বলেছিলেন, “হে আবু বকর, প্রত্যেক জাতির আনন্দ উৎসবের দিন আছে আর এটা হলো আমাদের ঈদের দিন। (বুখারী শরীফ, হাদীস : ৯৫২)

বর্ণিত হাদীসে ইসলামী সংস্কৃতির স্বকীয়তা বিশেষত্ব ও আদর্শ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। দু:খ জনক হলেও সত্য যে, আজকের মুসলিম সমাজ নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে পাশ্চ্যত্যের অন্ধ অনুকরণে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে। আজকে মুসলিম পরিবারের শিশু কিশোর, যুবক, যুবতীরা আনন্দ বিনোদনের নামে কুরুচিপূর্ণ অশ্লীলতায় ভরপুর নাটক, সিনেমা, অশ্লীল সঙ্গীত উপভোগে মত্ত হয়ে নিজেদের আদর্শিক ভিত্তি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিনিয়ত লংঘন করে যাচ্ছে।

ঈদুল ফিতর মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার উপহার: ঈদুল ফিতর একটি পবিত্র আনন্দের দিন। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাধ্যমে অর্জিত তাকওয়া মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ উপহার। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঈদুল ফিতর পুরস্কার প্রাপ্তির দিন। (জামেউল আহাদিস, হাদীস: ৩৯২০৭)

ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে আমরা যেন এমন কোন অন্যায় অপরাধ ও গুনাহের কাজে জড়িত না হই যা আমাদের অর্জিত তাকওয়া বিনষ্ট করে দেবে।

রমজানের আনন্দ ও ঈদের আনন্দের তুলনা হয় না: মুমীন জীবনে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার নিমিত্তে ব্যয়িত প্রতিটি মূহুর্তই ইবাদত। দৈনিক যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, কিয়ামুল লায়ল, তাহাজ্জুদ আদায়, হালাল উপায়ে উপার্জিত রিযক ভক্ষণ, সেহেরী, ইফতারী গ্রহণ, একাধারে বিশ রাকাত তারাবীহ আদায়, দিবারাত্রি মহাগ্রন্থ আল কুরআন তিলাওয়াতের সৌভাগ্য অর্জন, দরিদ্র, অসহায়, দুঃস্থ, মানুষের কল্যাণে সাধ্যমতো দান সাদকা, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ ইত্যাদি কল্যাণধর্মী মহৎ কার্যাবলী সম্পাদন যেন তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গড়ার এক মাসব্যাপী ট্রেনিং কোর্স। এ প্রশিক্ষণ আত্নশুদ্ধির, এ প্রশিক্ষণ মহাআনন্দের, এ আনন্দের তুলনা হয়না। ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা একে অপরের সাথে আনন্দের ভাগাভগি করে নেয়, এতে ইসলামের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য ফুটে উঠে।

ঈদের নামে ভোগ নয় ত্যাগেই আনন্দ: ঈদ কে কেন্দ্র করে মার্কেটিং করা, শপিং করা, ঈদ উপলক্ষে প্রয়োজনীয় কেনা কাটা করা এসব কিছু দোষের না। এতে পরিবার পরিজন, ছেলে, সন্তানদের আনন্দ রয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসীলায় শরীয়ত সম্মত পন্থায় আনন্দ উদযাপনের জন্য আমাদের জন্য এ দুটো ঈদ দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য। আনন্দ উদযাপনের নামে আমরা যেন মাত্রাতিরিক্ত, সীমালংঘন না করি, বাড়াবাড়ি না করি। আমাদের চারপাশে কতো অসহায় ক্ষুধার্ত, বঞ্চিত, দুঃস্থ, অবহেলিত মানুষেরা মানবেতর জীবন যাপন করছে, চিকিৎসার অভাবে কতো বনী আদম ধুকে ধুকে মরছে, তাদের দু:খ কষ্ট যন্ত্রণা লাঘবে অভাব মোচনে চাহিদা পূরণে আমরা কি তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি? অথচ আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে দেশের নামী দামী মার্কেটে গিয়ে সপ্তাহ ব্যাপী শপিং করে খোদা প্রদত্ত নিয়ামত ও সম্পদের অপব্যয় ও অপচয় করে যাচ্ছি সিয়াম সাধনার সংযমের মাসে এ আচরণ কি ইসলামী শরীয়ত সমর্থন করে? রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র কে এক শ্রেণির সুযোগ সন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি করে এক মাসেই যেন সারা বছরের মুনাফা তুলে নেন। বড় বড় শপিংমল গুলোতে মাসব্যাপী অপ্রয়োজনীয় লাইটিং করে জাতীয় বিদ্যূতের যে অপচয় করা হচ্ছে তা দেখে দেশকে কেউ গরীব দেশ বলে ধারণাও করতে পারবেনা। রাতভর শপিংমল গুলোতে মুসলিম পরিবারের মা বোনেরা ঈদের কেনাকাটায় সময় অতিবাহিত করছে যেখানে ইজ্জত আব্রু ও হিজাবের লংঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যা সিয়াম সাধনার পবিত্র মাসে রমজানের প্রকৃত উদ্দ্যেশ্যকে চরমভাবে ব্যহত করছে।

ঈদের রাতের ফযীলত: মুসলিম নরনারীর জন্য ঈদের রজনীর গুরুত্ব অপরিসীম। ঈমানদার বান্দাগণ, এ রজনীকে স্বীয় প্রভূর ক্ষমা লাভের প্রত্যয়ে ইবাদত বন্দেগী, যিকর, আযকার, ও নবীজির উপর অধিক হারে দরুদ শরীফ পাঠ ও নফল ইবাদতে নিয়োজিত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রত হন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত উবাদা ইবন সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রজনীতে রাতজেগে ইবাদত করবে তার অন্তর সেদিন মরবেনা, যেদিন অন্তরসমূহ মরে যাবে। (তাবরানী, হাদীস: ১৫৯, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৪র্থ, পৃ: ১০৫)

ঈদের নামায সংক্রান্ত মাসায়েল: . ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামায ওয়াজিব। ঈদের নামাযে আযান ও ইকামত নেই। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৭৭৯), . জুমার জন্য খুত্‌বা শর্ত, ঈদের জন্য খুত্‌বা সুন্নাত। জুমার খুত্‌বা নামাযের আগে, ঈদের খুত্‌বা নামাযের পরে। (দুররে মোখতার, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৬০), . ঈদের নামাযের সময় সূর্যোদয়ের ২০/২৫ মিনিট পর থেকে শরয়ীভাবে অর্ধদিন পর্যন্ত। ঈদুল ফিতর একটু দেরীতে ঈদুল আযহার নামায তাড়াতাড়ি পড়া মুস্তাহাব। (দুররুল মুখতার, ৩য় খন্ড, পৃ: ৬০)

ঈদের দিনে সুন্নাত আমলসমূহ: . ঈদের দিন গোসল করা সুন্নাত। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন গোসল করতেন। (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ১৩১৫)

গুনাহমুক্ত দিনই প্রকৃত ঈদের দিন: ঈদ মানে আনন্দ, মুমিনের প্রকৃত আনন্দ অনূভূতি প্রসঙ্গে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেন, . যেদিন মুমীনের জীবন গুনাহ থেকে মুক্ত হবে সেদিনটি হবে তাঁর জন্য ঈদের দিন।

. মু’মীন যেদিন ঈমান সহকারে মৃত্যু বরণ করবে, সেদিন হবে তাঁর প্রকৃত ঈদের দিন। (ফকীহ আবুল লাইস, আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ১০২)

ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য ও শিক্ষা প্রসঙ্গে শাহেনশাহে বাগদাদ (.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর সৃষ্টিরাজি বলছে আগামীকাল ঈদ। কাল ঈদ, সকলেই খুশী আনন্দে বিভোর, কিন্তু আমার সমাপ্তি যেদিন ঈমানের উপর হবে সেদিনই আমার জন্য ঈদের দিন হিসেবে গন্য হবে। (আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড)

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় সুন্নাত:

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ইসলামের প্রাচীনতম ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাহাবাগন ঈদের দিন পারস্পরিক সাক্ষাতে বলতেন, “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের কবুল করুন।

ঈদুল ফিতরের সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ঈদুল ফিতরের প্রকৃত শিক্ষা আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক: মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদ আনন্দ
পরবর্তী নিবন্ধপবিত্র রমজানের শেষে ঈদের খুশির যথার্থতা