মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো বয়স নেই। এদেশের মাটিতে লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ঘুমিয়ে আছেন। তাই এ মাটি এত প্রতিবাদী। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। হাসপাতালের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানানোর চেষ্টা যারা করছেন তারা ভুল করছেন। আজকের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ, এমপি-মন্ত্রীদের দেশপ্রেমে ঘাটতি আছে বলেই আমলারা তাদের ঘিরে ফেলেছে। রাজনীতিবিদদের উচিত মানুষের কথা শোনা। শহীদের রক্তে রঞ্জিত মাটি নিয়ে ব্যবসা করতে চাওয়া, এটা বাংলাদেশের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান।
সিআরবি রক্ষার্থে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে গতকাল রোববার দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ এ অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে দুঃসাহসী কাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ফেলেছেন। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রবকে প্রধানমন্ত্রীর চেনার কথা। তিনি যখন চাকসুর জিএস ছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একজন নেতা এখানে এসে বলেছেন, কেউ নাকি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন। প্রকৃতপক্ষে পানি ঘোলা করছে রেল কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, গোয়ালপাড়ায় হাসপাতাল হচ্ছে। আসলে শহীদ আবদুর রব কলোনি ভেঙে হাসপাতাল হচ্ছে। অর্বাচীন আমলারা ভুল বুঝিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে চাচ্ছেন। এই শহীদ আবদুর রব কলোনিতে আরও শহীদের কবরসহ নানা স্মৃতির উপর হাসপাতাল করতে দেওয়া যাবে না। আশা করি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে হাসপাতাল প্রকল্প সিআরবি থেকে সরিয়ে নেবেন।
‘সিআরবি ধ্বংস করে হাসপাতাল চাই না, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসুন’ স্লোগান নিয়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি স্মরণ অনুষ্ঠান থেকে সিআরবিতে শহীদের স্মৃতির উপর হাসপাতাল করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশাজীবী এ ঘোষণা দেন। সিআরবিতে প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় শতবর্ষী রেইনট্রিতে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রবের নামফলক স্থাপনের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির শুরু হয়। এরপর আলোচনা এবং সর্বশেষ আরও নয়জন শহীদের নামে প্রকল্প এলাকার গাছগুলোতে নামফলক লাগানো হয়।
কর্মসূচিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, বড়লোকের ইউনাইটেড হাসপাতাল চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না। চট্টগ্রামের মেয়র আর সিডিএ চেয়ারম্যান বলছেন তারা এখানে হাসপাতাল চান না। তারপরও কত বড় সিন্ডিকেট যে এখানে হাসপাতাল করতে চায়। দুদককে বলব রেলের কারা এ কাজ করছে তাদের খোঁজ নিন। রেল কারো বাবার সম্পত্তি না। এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরো জোরদার করতে হবে। যতদিন প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা না হবে ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য গণমঞ্চ তৈরি করুন। মুক্তিযোদ্ধারা এ আন্দোলনের সাথে আছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী অদম্য নেত্রী। তিনি চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবেন। নিশ্চয় উনার কাছে এতদিনে এ বার্তা পৌঁছে গেছে। আশা করি তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন। আর যে রাজনীতিবিদরা ইনিয়ে বিনিয়ে হাসপাতালের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারা অপকর্ম করছেন। এর প্রায়শ্চিত্ত তাদের এ জীবনেই করতে হবে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। রেল কারো পৈত্রিক সম্পত্তি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে প্রতারণা করলে জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না।
কবি সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, রেলের জমি সংরক্ষণ করার কথা রেল কর্তৃপক্ষের। উল্টো তারাই সে জমি দিয়ে দিচ্ছে আর আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। আমাদের একটাই দাবি, এখানে কোনো হাসপাতাল হবে না। কেউ বলছে শিরীষতলায় হবে না গোয়ালপাড়ায় হবে। তাদের চিহ্নিত করে রাখুন। এরাই দেশের শীর্ষজনকে ভুল বুঝিয়ে এই প্রকল্প নিয়েছেন। তারা গণশত্রু। ইউনাইটেডের টাকা খেয়ে তারা এ কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীকে তারা ভুল বোঝাচ্ছেন। শেষ কথা এখানে আমরা কোনো বেসরকারি হাসপাতাল হতে দেব না।
আয়োজক পিপল’স ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মনসুর, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাঈনুদ্দিন দুলাল, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মোরশেদুল আলম চৌধুরী প্রমুখ।
উপস্থিত ছিলেন খেলাঘর মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী রূপক চৌধুরী, সাংবাদিক ও শিল্পী আলোকময় তলাপত্র, সাংবাদিক মিন্টু চৌধুরী ও ঋত্বিক নয়ন, কারিতাসের শ্যামল মজুমদার, শিক্ষিকা মাগ্রেট মনিকা জিন্স ও শেখ বিবি কাউসার, সংগঠক বনবিহারী চক্রবর্তী, সাংবাদিক উজ্জ্বল ধর, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের প্রকৌশলী সিঞ্চন ভৌমিক, যুব সংগঠক রুবেল দাশ প্রিন্স, যুব মৈত্রীর খোকন মিয়া, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত নবী খোকা, প্রকৌশলী অমিত ধর, সাংবাদিক পার্থ প্রতিম বিশ্বাস ও আমিন মুন্না, তাপস দে, নিউটন দাশ প্রমুখ। প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন নারায়ন দাশ।
টিসিজেএ : সিআরবি এলাকায় প্রস্তাবিত হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদে মানববন্ধন, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেছে চট্টগ্রাম টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (টিসিজেএ) চট্টগ্রাম। টিসিজেএ সভাপতি এনামুল হকের সভাপতিত্বে ও দিপঙ্কর দাসের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন চ্যানেল আইয়ের ব্যুরো প্রধান চৌধুরী ফরিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মন্জুরুল কিবরিয়া, সমাজকর্মী জেসমিন সুলতানা পারু, লায়ন নবাব হোসেন মুন্না, টি-ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মো. তারেক, ছাত্রনেতা তফাজ্জল হোসেন জিকু, টিসিজেএর সহসভাপতি আলী আকবর, মো. আলমগীর, নুর হাসিব ইফরাজ, অমিত দাস, ফরিদ উদ্দিন, হাসান উল্ল্যাহ, বাসু দেব, আরশাদ আলী, ইমরান ইমু, সময় টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার পার্থ প্রতিম বিশ্বাস, এসএ টেলিভিশনে ইনচার্জ সোহাগ কুমার বিশ্বাস, মোহনা টেলিভিশনের রিপোর্টার সুমন কুমান দে, সরোয়ার আলম বাবু, আব্দুল হক, লিটন মজুমদার, মো. রহিম, ইবান, অনিক বিশ্বাস, মৌলানা মহিবুল্ল্যাহ প্রমুখ। পরে সিআরবির আশেপাশের বিভিন্ন খালি জায়গায় ফলদ, বনজ, ঔষধী গাছ রোপণ করা হয়।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন : চট্টগ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্যের সিআরবিতে কোনো ধরনের স্থাপনা চট্টগ্রামবাসী মেনে নেবে না। গতকাল প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন ডা. আর কে রুবেল, সজল চৌধুরী, মো. সেলিম, উত্তর কুমার দে, মো. কুতুব উদ্দিন প্রমুখ।
বিএইচআরএফ : সিআরবি টাইগারপাস ইস্যুতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবরে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করার ঘোষণা দিয়েছে বিএইচআরএফ। গতকাল সিআরবিতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আইন, গেজেট ও মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সিআরবি টাইগারপাস জোনে কোনো স্থাপনার নকশা অনুমোদনের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও এবং প্রস্তাবিত স্থানে মহান মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকজন বীর শহীদদের সমাধিস্থল থাকার বিষয়টি গোপন করে সরকার প্রধানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইউনাইটেড প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের জন্যে রেলের মূল্যবান জমি নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ প্রদানের চুক্তি সম্পাদনকারীদের অবিলম্বে দুদক আইনে গ্রেপ্তার ও তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্যে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করবে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফ। বিএইচআরএফএর মতে, এটা ফৌজদারী অপরাধ। সরাসরি দুদক কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করে কোনো ফল না পেলে বিজ্ঞ মহানগর দায়রা জজ/সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দুর্নীতি দমন বিশেষ আইনে মামলা দায়ের করা হবে।
বাপা চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার : সিআরবিতে হাসপাতাল ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিআরবি চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সিআরবি এলাকায় এই প্রকল্প স্থাপিত হলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব শুধু প্রকল্পের নির্দিষ্ট স্থানেই সীমিত থাকবে না। এটি শুধু শতবর্ষী বৃক্ষ না কাটার বিষয় নয়; সময়ের প্রয়োজনে প্রকল্প এলাকা ঘিরে নতুন নতুন দালান, অবকাঠামো, দোকানপাট, পার্কিং, ফার্মেসি, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের জন্য আবাসিক ভবনে ছেয়ে যাবে। যার ফলে পরিবেশ দূষণ ঘটবে এবং পুরো সিআরবি এলাকাটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক বলয় হুমকির মুখে পড়বে। এটি দেশের সংবিধান ও পরিবেশ আইন বিরোধী একটি হঠকারী ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
বিজয় ৭১ : সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদে বিজয় ৭১-এর মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপস্থিত ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, বিজয় ৭১-এর সভাপতি সজল চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ডা. আর কে রুবেল, আবৃত্তিশিল্পী মুজাহিদুল ইসলাম, শামসুল হায়দার তুষার, উত্তম কুমার দে, ডা. মনির আজাদ প্রমুখ।