নৈতিক বোধে কেন বিপর্যয়

দুই শিক্ষাবিদের দৃষ্টিতে

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

নৈতিক বোধের উপর ভিত্তি করে একটা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল বলেই সমাজটা এতো সুন্দর ছিল। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি বহুলাংশে ক্ষতবিক্ষত। পারস্পরিক বিশ্বাসের মাঝে ধস নেমে গেছে। এখন আমি আমার আমিত্বকে নিয়ে কীভাবে খুশি থাকব সে চিন্তায় মগ্ন। আমরা এখন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব পাচ্ছি না, অনুসরণীয় আদর্শ পাচ্ছি না। বিকৃতির একটা অশুভ পত্তন ঘটছে এখন বাংলাদেশে। পারিবারিক সংবিধান চালুর মাধ্যমে এ বিকৃতি রোধ করার সময় এখনো আছে। চট্টগ্রাম তথা দেশের দুই কৃতী শিক্ষাবিদ তবুও আশাবাদী যে, সবসময় শুভশক্তির জয় হয়। দেশে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। সেই ভালো মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে সংগঠিত করতে হবে অশুভ শক্তি বিনাশে। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ধর্ষণ, পরকীয়া, কিশোর গ্যাং কালচারসহ সামাজিক অপরাধসমূহকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, আইনগত, সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য কাজকে আমরা বলি অপরাধ। আর যেটা নীতি নৈতিকতা বহির্ভূত বা ধর্মীয় অনুষঙ্গের বাইরে বা আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, মূল্যবোধের বাইরে সেগুলো হচ্ছে পাপ। যেমন আগে আমরা ছেলেবেলায় শিখতাম, সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যা বলিলে মা বাবা রাগ করবেন। এই যে ছেলে মেয়ের সাথে মা বাবার কো রিলেশন, এটা এখন নেই। নৈতিক বোধের উপর ভিত্তি করে একটা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল বলেই সমাজটা এতো সুন্দর ছিল। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি আমরা বহুলাংশে ক্ষতবিক্ষত দেখতে পাচ্ছি। ডিজিটালাইজেশনের ব্যবহার সমাজকে উন্নত করে, কিন্তু অপব্যবহার সমাজকে বিপথে ঠেলে নিয়ে যায়। ইলেকট্রনিকস কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় যেসব ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে, তা উঠতি বয়সীদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ উত্তেজনা প্রশমনে বিকল্প ব্যবস্থা নেই। বিশ্বের উন্নত দেশে ১৮ বছরের পর ছেলে মেয়ে এডাল্ট। সে দেশে ১৮ বছরের একটা ছেলের একটা মেয়ে বন্ধু না থাকলে মা বাবা চিন্তায় পড়ে যান যে তার মানসিক কোনো সমস্যা আছে কিনা।
আমাদের ডিজিটালাইজেশনে একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে কীভাবে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই তরুণ প্রজন্মের কাছে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশকে উপহার দেব। ডিজিটালাইজেশনের যে ডিভাইসগুলো আছে, সেগুলো আমরা কতো যৌক্তিকভাবে সদ্ব্যবহার করব। আগে আমরা ভাই বোন একসাথে থাকতাম। এখন দশ বছর বয়স থেকে মা বাবা সন্তানকে আলাদা করে দিচ্ছে। আমার যে ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, সাথে সাথে মেন্টাল ডেভেলপমেন্টও হচ্ছে। মনের চাহিদা, শারীরিক চাহিদা দুটো কিন্তু সমার্থক। আমার মনটা কিন্তু কিছু করতে চায়। সাথে শরীরের চাহিদাও রয়েছে। ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্টের সাথে ফিজিক্যাল অর্গানগুলো ডেভেলপ করছে। তখন মন থেকে সে কিছু করতে চায়। তখন তার অর্গানগুলো তাকে উত্তেজিত করছে। সেগুলো যদি সে করতে না পারে, তখন সে বিকৃত রুচির দিকে যাচ্ছে। বিকৃতির একটা অশুভ পত্তন ঘটছে এখন বাংলাদেশে। উত্তরণের উপায় হলো তাদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা যদি প্রোথিত করতে পারি। আর সেটা যদি পারি, তাহলে সামাজিকীকরণের সেই হারানো জায়গায় আমরা ফিরে যেতে পারব। আধুনিকতার মানে এই নয় যে ফেসবুকে প্রেম করে তাকে গণধর্ষণের শিকার করব। যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে আমি আশাবাদী। সবসময় শুভশক্তি জয় হয়। দেশে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি।
শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক ড. আনোয়ারা আলম বলেন, আমরা সব কিছুকে পণ্য সভ্যতার মধ্যে নিয়ে আসছি। নারীকে এই ভোগবাদী সমাজে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। এটা বিশেষত: আকৃষ্ট করছে উঠতি বয়সীদের। তাদের মধ্যে একটা বাসনা জাগিয়ে দিচ্ছে। যাদের ভেতরে সুশিক্ষা নাই, নৈতিক শিক্ষা নাই তাদের মধ্যে বাসনাটা বেশি করে জাগছে। আজ এত এত ধর্ষণের মূল কারণ কিন্তু এটাই। সাথে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটের পর্নসাইটগুলো। আরেকটা কথা বলা প্রাসঙ্গিক, একটা সময়ে সব দেশেই উঠতি বয়সী ছেলেদের এ ধরনের বাসনা পূরণের নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। এখন সেটা নেই। এর ফলে সামনে যাকেই পাচ্ছে সে শিশু, নাকি বৃদ্ধা দেখছে না। তার সাথে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতো আছেই, উল্লেখযোগ্য বিচার হচ্ছে না। করোনাকালেও ধর্ষণটা মহামারী আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘ যেটাকে ছায়া মহামারী বলছে।
এখন আমি আমার আমিত্বকে নিয়ে কীভাবে খুশি থাকবো, এটা করতে গিয়ে পরকীয়াটা বিকৃত মানসিকতায় রূপ নিয়েছে। দেবর ভাবীর যে সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে, এ সম্পর্ক কিন্তু যুগে যুগে ছিল। নৈতিকতার এ অবক্ষয়টা কোন ভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে দুজনেরই দায় আছে। এ অপকর্মগুলো ভেতরে ভেতরে আগেও হতো। এটা অস্বীকার করা যাবে না। এখন হচ্ছে কি, দেবরটা ব্ল্যাকমেইল করছে। সম্পর্কটাকে উপভোগ করেছে, আবার তাকে ট্র্যাপে ফেলে স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে। এর জন্য প্রথমত পরিবার দায়ী। পারিবারিক বন্ধনে চিড় ধরে গেছে। আমরা মা বাবারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখছি না, তাকে অবজারবেশনে রাখছি না। এর ফলে সন্তানের মধ্যে মানবতাবোধ জাগছে না। সে ডাইভার্ট হয়ে পড়ছে। পারিবারিক শৈথিল্যের পাশাপাশি সময়ের বিনোদন মাধ্যমগুলো আমাদের একটা ভোগবাদী সভ্যতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি পারিবারিক একটা সংবিধান থাকা উচিত। যার মাধ্যমে পরিবারে কিছু রুলস রেগুলেশন থাকবে, যেগুলো পরিবারের সবাইকে মেনে চলতে হবে। বিশ্বাসের জায়গাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। নয়তো এ অবক্ষয় চলতেই থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকাত্তরের পরাজিত অপশক্তির আস্ফালন ঠেকাতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে হামলাকারীরা মানবতা ও সভ্যতার শত্রু