নানাভাবে চেষ্টা করেও চালাতে না পেরে অবশেষে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে কন্টেনার পরিবহনের জন্য কেনা জাহাজ তিনটি নিলামে তোলা হচ্ছে। প্রায় ৫৬ কোটি টাকা দিয়ে চীন থেকে কেনা পুরনো জাহাজ তিনটি অন্তত তিন বছর ধরে অলস বসে আছে। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠা জাহাজ তিনটি নিলামে বিক্রির মাধ্যমে ‘আপদ’ বিদায় করা হচ্ছে। অবশ্যই বিষয়টিকে এভাবে দেখা ঠিক হবে না উল্লেখ করে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও রুটে কন্টেনার পরিবহনের ‘পথ দেখানোর’ জন্যই জাহাজ তিনটি কেনা হয়েছিল। কিন্তু কিছুটা সমস্যা হলেও সেই পথ তৈরির মাধ্যমে বন্দরের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুট পুরোদমে চালু হলে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলেও তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) ১০ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৭২ টন কার্গো (পণ্য) হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। এই সময় বন্দরে কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে ৩০ লাখ ৪ হাজার ১৪২ টিইইউএস। আগের অর্থবছরে যা ছিল ২৯ লাখ ১৯ হাজার ২৩ টিইইউএস। দেশের আমদানি বাণিজ্যের ৮৫ ভাগ এবং রফতানির ৮০ ভাগ পরিচালিত হয় এই বন্দর দিয়ে। সমুদ্রপথের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই সম্পন্ন হয় এই বন্দর দিয়ে। আবার চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বর্তমানে যে পরিমাণ কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশ ঢাকা এবং সন্নিহিত অঞ্চলের। প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয় ঢাকা অঞ্চলের। এই বিপুল সংখ্যক কন্টেনারের খুব সামান্য একটি অংশ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথে ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে পাঠানো হয়। প্রতি মাসে সর্বোচ্চ হাজার পাঁচেক কন্টেনার বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিবহন করতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা এবং সন্নিহিত অঞ্চলের যে পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিং হয় তার মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ পরিবহন করতে পারে রেলওয়ে। ৮৫ শতাংশেরও বেশি পরিবাহিত হয় সড়ক পথে। এরমধ্যে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ কন্টেনার মুভার এবং ৭০ শতাংশের বেশি ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর চাপ কমানো এবং নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী পথ হিসেবে আখ্যায়িত নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে একটি কন্টেনার টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়। বিআইড্লিব্লউটিএর ৩২ একর জায়গার উপর নির্মাণ করা হয় এই টার্মিনাল। টার্মিনালটি নির্মাণ করার পর কন্টেনার পরিবহন ত্বরান্বিত করতে চট্টগ্রাম বন্দর-পানগাঁও টার্মিনালে কন্টেনার পরিবহনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৩২টি জাহাজ কেনার জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়। কিন্তু লাইসেন্স নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানও নির্দিষ্ট সময়ে কোনো জাহাজ তৈরি বা কিনতে পারেনি। এতে সব আয়োজন সম্পন্ন হলেও অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল উপযোগী কন্টেনার জাহাজের অভাবে রুটটি চালু করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই অবস্থায় ২০১৩ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা খরচ করে চীন থেকে তিনটি পুরনো কন্টেনার জাহাজ ক্রয় করে। এমভি পানগাঁও এঙপ্রেস, এমভি পানগাঁও ভিশন ও এমভি পানগাঁও সাকসেস নামক পুরনো জাহাজ তিনটির প্রতিটি ১২০ থেকে ১৪০টি কন্টেনার পরিবহন ক্ষমতাসম্পন্ন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ তিনটি চালানোর ব্যাপারে নানাভাবে চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সামিট গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসএপিএলকে জাহাজ তিনটি পরিচালনার জন্য ভাড়া দেয়া হয়। প্রতিটির জন্য মাসিক ১৪ লাখ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। প্রায় দুই বছর আট মাস চালানোর পর এসএপিএল বন্দর কর্তৃপক্ষকে জাহাজ তিনটি ফেরত দেয়। এই ফেরত দেয়ার সময়ও তৈরি হয় জটিলতা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ ভাড়ার বকেয়া টাকা পরিশোধ এবং জাহাজের কন্ডিশন ঠিকঠাক করে দেয়ার দাবি করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং এসএপিএল কয়েক দফায় আলোচনা করার পর প্রায় ছয় মাস পর জাহাজ তিনটি গ্রহণ করে। এই সময় ওই গ্রুপটি বন্দর কর্তৃপক্ষকে এক কোটি টাকার মতো প্রদান করে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে জাহাজ তিনটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়ার পর আর চালানো সম্ভব হয়নি। বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন করে ভাড়া দেয়ার চেষ্টা করলেও ১৪ লাখ টাকার স্থলে মাসিক মাত্র তিন লাখ টাকা ভাড়া দেয়ার প্রস্তাব করে একটি কোম্পানি। এতে করে জাহাজগুলো ভাড়া দেয়াও সম্ভব হয়নি। অলস বসে থাকা জাহাজ তিনটি একটা সময় বন্দরের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠে।
অবশেষে জাহাজ তিনটি নিলামে বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ তিনটির বর্তমান অবস্থায় কত টাকা বিক্রি করা যেতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে সার্ভে করারও উদ্যোগ নিয়েছে। ডিজি (শিপিং) কার্যালয়ের সার্ভেয়ার দিয়ে জাহাজ তিনটি সার্ভে করা হবে বলেও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাহাজ তিনটি বিক্রির উদ্যোগের কথা স্বীকার করে বলেন, জাহাজ তিনটি যে সময় কেনা হয়েছিল তখন এর কোনো বিকল্প ছিল না। যে বা যারা পথ দেখায় তাদের কিছুটা বাড়তি কষ্ট সহ্য করতে হয়। এক্ষেত্রেও বন্দর কর্তৃপক্ষকে কিছুটা বাড়তি ঝুঁকি নিতে হয়েছে। ওই সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ তিনটি জাহাজ কিনে পথটি চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল বলেই আজ চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে নয়টি বেসরকারি কন্টেনার জাহাজ চলাচল করছে। ভবিষ্যতে এই রুট পুরোদমে চালু হলে দেশের শত শত কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।