সেবক এম. সামশুল হক ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পটিয়ার অন্তর্গত কৈয়গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব পোষ্টমাষ্টার, খ্যাতনামা শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক এস. আহমদ হোসেন এবং মা চেমন খাতুন এর দ্বিতীয় পুত্র। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, ভাষাসৈনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডক্টর মাহফুজুল হক এর ভাই।
সামশুল হকের প্রাইমারী শিক্ষার জীবন শুরু হয় তার নিজ গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ঢাকাস্থ ওয়েস্টেন্ড হাই স্কুলে এক বছরের পাঠগ্রহণ শেষে পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুল থেকে এসএসসি, সরকারী কমার্স কলেজ হতে আই.কম ও একই কলেজ হতে ১৯৬৭ সালে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজে এলএলবি কোর্সে ভর্তি হলেও রাজনৈতিক কারণে শেষ করা হয়ে উঠেনি।
পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি সিডিএ এর অধীনে ঠিকাদারী ব্যবসা ও পরে বিএন্ডএফ, সার্ভেয়ার্স এন্ড ইস্পপেকশান ও আমদানী–রপ্তানী ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তিনি টেকনো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েট লিঃ এর পরিচালক, মেসার্স এ. হামিদ ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ এর রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর হিসেবে উক্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।
এ সময় ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাষ্ট্রিজের শিল্পবিষয়ক কমিটির কো–চেয়ারম্যান, ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি চট্টগ্রাম ট্রেডার্স কো–অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের ডাইরেক্টর পদে ও পরে ২০০৫ পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে অধিষ্টিত ছিলেন।
উল্লেখ্য রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসাবে মুসলিম হাই স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে তিনি নিজেকে নানা আন্দোলন সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এসময় ১৯৬২ সালে বিতর্কিত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবীতে আন্দোলন করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন। কলেজ জীবনে ১৯৬৩ সালে থেকে তিনি সরকারি কমার্স কলেজে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ৬৬’র ছয়দফা, ও ৭০ এর নির্বাচনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বাড়ি পটিয়া হলেও রাজনীতির হাতেখড়ি শহরের ফিরিঙ্গিবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু নিজেই জানে আলম দোভাষের বাড়িতে বসে সামশুল হককে এ পদ দিয়েছিলেন। সে হতেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাহিত সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৬৯ সালে তিনি কোতোয়ালী থানার ফিরিঙ্গিবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ৬৯ এর গণ–অভ্যূত্থানের সময় তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী হয়। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন সংগঠক হিসাবে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও অবদান রাখেন।
স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর কিছুদিন আত্মগোপন থাকেন এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী নিবাসী নুরুল ইসলামের কন্যা শাহেদার সাথে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৭৭ সালে প্রথমে জিরি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, পরবর্তীতে দু’বার পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৩ সালে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক, ৯১ সালে যুগ্ম সম্পাদক এবং ৯৬ সালে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়ে পরবর্তীতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৭৬ সালে তিনি লায়নিজমের প্রতিষ্ঠাতা এম. আর সিদ্দিকীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে লায়নিজমের সাথে সম্পৃক্ত হন। শুরু থেকেই একজন সক্রিয়, ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান সমাজসেবক হিসেবে তিনি লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং প্রেসিডেন্সির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক (১৯৭৭–৭৯) ও পরবর্তীতে সভাপতি হন।
চট্টগ্রাম লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালের সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮১–৮৩ সাল পর্যন্ত। তিনি লায়ন্স জেলা পর্যায়ে ১৯৮৩ সাল থেকে বেশ কয়েকবার কো–চেয়ারম্যান, ডিষ্ট্রিক চেয়ারম্যান, জোন চেয়ারম্যান এবং রিজিয়ন চেয়ারম্যান পদে সাফল্যের সাথে দায়িত্ পালন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি লায়ন্স ডিষ্ট্রিক ৩১৫বি–৪ বাংলাদেশের অধীনে চট্টগ্রামের প্রথম চীফ কো–অর্ডিনেটর পদে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। লায়ন্স অঙ্গনে নিরলস সক্রিয়তা, প্রজ্ঞা ও বহুমুখী কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পরপর চারবার ‘বেস্টলায়ন’ নির্বাচিত হন। লায়ানিজমের লক্ষ্য ও আদর্শ, মানবসেবাকে সুপ্রসারিত করার ক্ষেত্রে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার স্বীকৃতিতে এম. সামশুল হক ডিষ্ট্রিক ও ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক সম্মান সূচক বহু পদক ও সনদপত্র লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ঢাকাস্থ ‘বাংলাদেশ লায়ন্স ফাউন্ডেশন’ এর ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৮–৯৯ বর্ষে ইন্টারন্যাশনাল লায়ন্স ডিষ্ট্রিক ৩১৫বি–৪ বাংলাদেশের গভর্নর নির্বাচিত হন। একই বছর লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল মাল্টিপল জেলা–৩১৫ বাংলাদেশের কাউন্সিল অব গভর্নর এর ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন।
গভর্নর হিসাবে নেতৃত্ব ও মানবতার সেবায় অনবদ্য অবদান রাখার জন্য আন্তর্জাতিক প্রেসিডেন্ট কর্তৃক তিনি ‘একসেলেন্ট গভর্নর এওয়ার্ডে’ ভূর্ষিত হন। যা ঢাকায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রদান করা হয়। তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সহ বিভিন্ন লায়ন্স ফোরাম ও আন্তর্জাতিক লায়ন্স সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে এবং ব্যক্তি জীবনে একাধিকবার তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মায়নমার, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, লেবানন, সৌদিআরব, মিশর, ইতালি সহ একাধিক আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও শহর সফর করেন। একজন বিশিষ্ট সমাজ সেবক হিসেবে এম. সামশুল হক এর পদচারণা ছিল চট্টগ্রামের সর্বক্ষেত্রে। ১৯৮৮ সালে বন্যা, ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৮ সালে দেশের ভয়াবহ বন্যা ও বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগ ও সংকট পরিস্থিতিতে সমাজসেবক হিসাবে সারাদেশ ব্যাপী যে ত্রাণ কার্য পরিচালনা করেন তা সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
অবহেলিত জনগোষ্ঠী ও সমাজসেবায় অনবদ্য অবদান রাখার ফলশ্রুতিতে এম. সামশুল হক ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন “দেশবন্ধু সি.আর.দাশ গবেষণা পরিষদ” কর্তৃক স্বর্ণপদক ও ২০০৬ সালে সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে “অধ্যক্ষ আবুল কাসেম সাহিত্য একাডেমী” কর্তৃক পদকে ভূষিত করা হয়। ২০০১ সালে তিনি “চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন সংস্থা” প্রতিষ্ঠা করেন, যার চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ভূতপূর্ব ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কাউন্সিল” এর জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি “কাউন্সিল অব রাইট এন্ড হিউমিনিটি’ নামের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারী জেনারেল ও দি সিনিয়র সিটিজেন সোসাইটি, চট্টগ্রাম এর সংগঠক ও জেনারেল সেক্রেটারীর দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম শহর ও পটিয়া সমিতি সহ অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ইচ্ছেও পোষণ করতেন। জন্মস্থান পটিয়া থেকে হতে চেয়েছিলেন এমপি। ২০০৮ সালের ৯ম সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের রাজনীতি–সচেতনেরা ভেবেছিলেন আশৈশব আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য সামশুল হক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবে না। কিন্তু রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণে সাদামনের এ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনোনয়ন পেয়েও পাননি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুনলে আশ্চর্য হবেন, চট্টগ্রামে যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সবার সঙ্গে আমার কমবেশি পরিচয় ছিল, নামও জানতেন। আমার দুর্ভাগ্য যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লালবার্তা, মুক্তিবার্তায় নাম দিইনি। তখন অনেকেই আমাকে নাম দিতে বলেছিলেন। আমি তখন বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি, নিজের মনের তাগিদে, দেশমাতৃকার টানে। ওই নাম দিয়ে কি হবে। সত্যি কথা বলতে, এখন কিন্তু খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার পাচ্ছেন, জাতীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত হচ্ছেন, তাদেরকে স্যালুট দেয়া হচ্ছে, ভাতা দেয়া হচ্ছে।’ একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব সামশুল হক ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বন্ধু বৎসল, সদালাপী, পরোপকারী, অমায়িক ও নিরঅহংকারী। তিনি ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একজন সাহসী, নির্ভীক এবং সর্বগ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে এবং বেশ কিছুদিন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ বেলা ২.৩০ টায় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আমরা আশাকরি, মরণোত্তর হলেও আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকার প্রধান নীরব এ রাজনৈতিক নেতার সঠিক মূল্যায়ন ও মর্যাদাদানে সচেষ্ট থাকবেন। প্রজন্মের জন্য এম. সামশুল হক একজন আদর্শ রাজনৈতিক, সমাজসেবক এবং মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠক হিসেবে বেঁচে থাকবেন। লেখক : প্রাবন্ধিক।