উন্নত দেশের আদলে পরিবহন সেক্টরকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়া প্রয়োজন

মুহাম্মদ মুসা খান | বৃহস্পতিবার , ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে, বিভিন্ন সেক্টরের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে লক্ষণীয় ভাবে। বিশ্বের দরবারে সক্ষম অর্থনীতির দেশ হিসেবে আমরা পরিচিত পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের পরিবহন সেক্টরের সার্বিক চিত্র নিম্নমুখী হয়েছে। গত ৭এপ্রিল২২ তারিখে সংসদে দেয়া তথ্যমতে দেশে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ৪৯ লাখ ৯১ হাজার যানবাহন রয়েছে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছেন প্রায় ১৯ লক্ষ (লাইসেন্স বিহীন চালক প্রায় ৩০ লক্ষ)। এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১০ বছর আগে ঢাকায় যান চলাচলের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, এই গতি বাড়ানোর জন্য ১০ বছরে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। অথচ আগের চেয়ে গাড়ির গতি কমে দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার (ঢাকা পোস্ট, সেপ্টেম্বর২২)

ঢাকার যানজট একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দেওয়াতেই যানজট নিরসনের জন্য ‘ফ্লাইওভার’, ‘মেট্রোরেল’, ‘‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ ইত্যাদি প্রকল্প নিয়ে এগোনোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে (এসব প্রকল্প নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি)। ‘পরিবহন সেক্টরের অব্যবস্থাপনা’ শুধু যে রাজধানী কেন্দ্রিকতা নয়। পুরো দেশই এই অব্যবস্থাপনার কবলে নিমজ্জিত। অপ্রতুল গণপরিবহন, বাসট্রাক মালিকশ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতা, শ্রমিক সংগঠন ও সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, বিআরটিসি বাসের অপ্রতুলতা, প্রাইভেট বাস মালিক কর্তৃক বিআরটিসি বাসের গতিরোধ, মফস্বল শহর ও উপজেলা পর্যায়ে থ্রি হুইলারের দাপট, ট্রাফিক বিভাগে লোকবল সংকট ও অনভিজ্ঞ ট্রাফিক পুলিশ, নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ বা বাস বেনা থাকা, ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, এলোপাতাড়ি রাস্তা পারাপার, জেব্রাক্রসিং না থাকা, স্পীড লিমিট না থাকা, ট্রাফিক সাইন না থাকা, ত্রুটিপূর্ণ ট্রাফিক সিগনাল ও স্বয়ংক্রিয় সিগনাল না থাকা, রাস্তার মোড়ে গাড়ির কাগজপত্র চেক করা, যত্রতত্র অবৈধ পার্কিং, শহর এলাকায় মাল্টি স্টোরড বিল্ডিং এ নীচতলাতে পার্কিং এর স্থলে দোকান তৈরি করা (এর ফলে ভবনের আসা গাড়ি পার্কিং করা হয় সদর রাস্তায়), যত্রতত্র স্কুলকলেজহাসপাতাল স্থাপন, বিআরটিএর অনিয়ম, কথায় কথায় বাসট্রাক ধর্মঘটইত্যাদি অনিয়ম পরিবহন সেক্টরে বিরাজ করছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ও রাস্তার সার্বিক পরিস্থিতিক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। অতীতে রাস্তাঘাট অপ্রশস্তথাকলেও প্রতিটি উপজেলা সদরের সাথে ‘কাঠবডি বাস চলাচল করতো। আমাদের চট্টগ্রামের কাপ্তাই, কানুনগোপাড়া, আনোয়ারা প্রভৃতি এলাকায় আমরা এই বাস সার্ভিস দেখেছি। কিন্তু এখন রাস্তাঘাট প্রশস্ত হয়েছে, অথচ মানুষের দুর্দশা কমেনি।

অদূরদর্শিতাঅদৃশ্য কারণেপুরো দেশ আজ বাসএর পরিবর্তে ভারতীয় থ্রি হুইলারে (সিএনজি বেবি টেঙি) সয়লাব হয়ে গেছে। চট্টমেট্রো ও চট্টগ্রাম (‘গ্রামগাড়ি বলা হয়) নম্বর দিয়ে বিআরটিএও পরিবহন মন্ত্রণালয় হাজার হাজার বেবিট্যাঙি বাজারে ছেড়ে দিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ৩/৪ জন পেসেঞ্জার নিয়ে এই টেক্সি রাস্তা দাপরিয়ে বেড়াচ্ছে এবং যানজট তৈরি করছে। এই থ্রি হুইলার চালকদের ৭০% ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। উচ্চপর্যায়ের ও বিআরটিএর দুর্নীতির কারণেই আজ দেড়/দুই লক্ষ টাকার সিএনজি টেক্সি ১৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০ বছরের স্থায়িত্ব ধরে বেবিট্যাক্সি ধ্বংস/রিপ্লেস করার নিয়মই দুর্নীতি বাড়িয়েছে। বিভিন্ন রুটে চলাচলরত এই টেক্সি হতে বেআইনিভাবে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। অথচ এই বেবিটেঙির স্থানে যদি পূর্বের বাস সার্ভিস ধরে রাখা যেতোতাহলে মানুষের ভোগান্তি কম হতো এবং দুর্নীতির সুযোগ কমে যেতো। উল্লেখ্য যে, সিএনজি টেক্সির উৎপত্তিস্থল ভারতেও সব রুটে যানজট সৃষ্টির অভিযোগে এটা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

অনেকে মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য বিআরটিসিকে কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছেন। অথচ বিআরটিসি ইতোমধ্যে বহুবার ফেল করেছে। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনতার পর হতেই লুটপাটের শিকার হয়েছে। বেসরকারি বাসকে সুবিধা দেয়ার জন্য অনেক রুট হতে বিআরটিসি বাস তুলে দেয়া হয়েছে। সুতরাং আর বিআরটিসি নয়, এবার প্রয়োজন বৃহৎ উদ্যোগ। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাকে ‘একটি কোম্পানির অধীনে আনার’ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যাতে সবাই আশান্বিত হয়েছিল। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ২০১৮ সনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকার ৯৮ ভাগ পরিবহন এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আত্মীয়দের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, দলের নেতা, মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও তাদের পরিবারের সদস্য, পুলিশ, সাংবাদিকও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রভাবশালী মালিক সমিতির অলিখিত নির্দেশে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএকেও হিসেব করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় বলে অভিযোগ আছে। পুলিশ, বিআরটিএ কর্মকর্তা, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নসহ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণেই পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরছে না।

রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও চালকদের কিছু হয় না বলেও অভিযোগ আছে’। প্রসঙ্গক্রমে গত ১১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরা যায়। তিনি বলেছিলেন– ‘আগামীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে, ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের স্বপ্ন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়বে’। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সোসাইটির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। আমরাও মনে করি, পরিকল্পনামাফিক দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করা গেলে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে আজকের পরিবহন সেক্টরের যে অরাজকতা বিরাজ করছে, সেই ‘অরাজকতা’ স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই পরিবহন সেক্টরের রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে গণপরিবহন শতভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সে সব দেশে গণপরিবহন তথা যাত্রীবাহী বাস সমূহ সরকারের নিয়ন্ত্রণে সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করে। আমাদের সরকার ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উচিত গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার জন্য উন্নত দেশের নিয়মে সমগ্র দেশের গণপরিবহনকে একটি কোম্পানি অর্থাৎ সরকারের আওতায় নিয়ে আসা।

এজন্য প্রয়োজনে বেসরকারি আইটি কোম্পানি বা বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো বাস থাকবে না। সব বাস সরকার অধিগ্রহণ করবে। ফিটনেস বিশেষজ্ঞগণ বাসের ফিটনেস বিষয়ে মতামত দেবেন। বর্তমানে চলাচলরত বাসগুলোর ডাটাবেস তৈরি করে সেগুলোকে যাত্রী অনুযায়ী বিভিন্ন রুটে ভাগ করে দিতে হবে। কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন বা মালিক সমিতি থাকবে না। মালিকদের মাসিক লভ্যাংশ দেয়া হবে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য থাকবে না, বরং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত যে সক্ষমতা অর্জন করেছেতাতে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, পরিবহন সেক্টরকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা মোটেই কঠিন কাজ হবে না। তবে প্রয়োজন আন্তরিক সদিচ্ছা ও বলিষ্ঠ উদ্যোগ। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই উদ্যোগ গ্রহণ করলেপরিবহন সেক্টরে যুগান্তরকারী পরিবর্তন আসবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, মুষ্টিমেয় লোকের দুর্নীতি, লোভ ও লাভের কারণে গণপরিবহনের নৈরাজ্য আমাদের নিয়তি হতে পারে না।

লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাতজাগা পাখি
পরবর্তী নিবন্ধনির্লোভ সমাজসেবক, রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক এম. সামশুল হক