নগরীর পতেঙ্গা থানার একটি মামলার ভিকটিম রহিমা (ছদ্মনাম)। নির্যাতনের শিকার তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন তৎকালীন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমান। রহিমার মতো একজন নারী ও একজন শিশুর জবানবন্দি রেকর্ড করার কথা একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটের, কিন্তু তা হয়নি। চান্দগাঁও ও হালিশহর থানার পৃথক দুটি মামলায় গত ২৫ জুন ও ২ জুলাই এ দুজন ভিকটিমের জবানবন্দি রেকর্ড করেন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট। তিন মাস আগে সিএমএম আদালতের একমাত্র নারী ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমান বদলি হওয়ায় বাধ্য হয়ে নির্যাতিত নারীর জবানবন্দি নিচ্ছেন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট। এতে ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল উচ্চ আদালতের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
নির্যাতিত নারীর জবানবন্দি নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক রেকর্ড করতে উচ্চ আদালতের দেয়া সেই নির্দেশনায় বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটনে ওয়াকিবহাল ব্যক্তির জবানবন্দি উক্ত আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়। অপরাধের তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে লিপিবদ্ধকৃত উক্ত জবানবন্দি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। স্পেশাল কমিটি ফর জুডিসিয়াল রিফর্মসের গোচরীভূত হয়েছে। বর্তমানে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী বা শিশুদের জবানবন্দি পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবন্ধ করা হচ্ছে। একজন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নারী বা শিশু ভিকটিম ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিতে সংকোচ বোধ করে। ফলে এরূপ নির্যাতনের শিকার শিশু বা নারী ঘটনার প্রকৃত বিবরণ দিতে অনেক সময় ইতস্তত বোধ করে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা আবশ্যক। এতে নারী বা শিশু ভিকটিমরা সহজে ও নিসংকোচে তাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে পারবে।
নির্দেশনায় আরো বলা হয়, সংঘটিত অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অর্পণের জন্য চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশিত হয়ে বিশেষভাবে অনুরোধ করা গেল। সংশ্লিষ্ট জেলায় বা মহানগরীতে নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্মরত না থাকলে অন্য কোনো যোগ্য ম্যাজিস্ট্রেটকে উক্ত দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। এই নির্দেশনা অনুসরণে কোনো সমস্যা বা অসুবিধা দেখা দিলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
আইনজীবীরা বলছেন, পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে জবানবন্দি দিতে সংকোচ বোধ করেন নির্যারিত নারীরা। তারা নারী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক আইনজীবী আকতার কবির আজাদীকে বলেন, পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্যাতনের শিকার নারীরা জবানবন্দি দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। এজন্যই উচ্চ আদালত কর্তৃক নির্দেশনা প্রদান করা হয়, নির্যারিত নারীর জবানবন্দি নেবেন নারী ম্যাজিস্ট্রেট। সেখানে এ–ও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জেলায় বা মহানগরীতে নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্মরত না থাকলে অন্য কোনো যোগ্য ম্যাজিস্ট্রেটকে উক্ত দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া দরকার। সেক্ষেত্রে আর কোনো সমস্যা থাকছে না। আশা করছি, সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি দেখবেন।
মহানগর পিপি আব্দুর রশিদ বলেন, নারী ম্যাজিস্ট্রেট না থাকার পরও পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটরা সচেতনতা এবং সতর্কতার সাথে নির্যারিত নারীদের জবানবন্দি রেকর্ড করছেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এরপরও একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা দরকার। পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিতে স্বাভাবিকভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না নির্যাতনের শিকার নারী।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নারী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সহজভাবে সবকিছু খুলে বলতে পারেন নির্যারিত নারী। এজন্য নারী ম্যাজিস্ট্রেট অপরিহার্য। আমরা চাই একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে সিএমএম আদালতে নিয়োগ করা হোক।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্য ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রয়েছে আটটি। এর মধ্যে একটি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, একটি অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও ছয়টি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এর মধ্যে সাতটিতে ম্যাজিস্ট্রেট (পুরুষ) রয়েছে। অন্যটিতে গত ২৮ মার্চ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নেই।












