নির্মাণ ব্যয় নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের বিরোধ

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অর্ধেক দিতে রাজি হলেও মানছে না কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি দায় এককভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণ ব্যয় নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) মধ্যে বিরোধ শুরু হচ্ছে। গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল খননের ৭ হাজার কোটিরও বেশি বিদেশি ঋণসহ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি দায় এককভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের ঘাড়ে তুলে দেয়ার চেষ্টা থেকে এই বিরোধের সূত্রপাত।

 

১৪.৩ কিলোমিটারের দীর্ঘ চ্যানেলটি উভয় সংস্থাই ব্যবহার করলেও খরচ এককভাবে দেয়া হচ্ছে বন্দরের উপর। বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মাঝেও সংশয় তৈরি হয়েছে। এই দায় চাপানোর পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা তা নিয়েও প্রকাশ করা হয়েছে সংশয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ চ্যানেলের নির্মাণ ব্যয়ের অর্ধেক দিতে রাজি হলেও তা মানা হচ্ছে না বলে সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর করার সময় বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগজি) ইনিশিয়েটিভ ঘোষণা করা হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার প্রেক্ষিতে দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। ওই ঘোষণার প্রেক্ষিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গ্রহণ করা হয় একটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প।

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহযোগিতায় মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমিতে কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ২০১৮ সাল থেকে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে প্রতিদিনই হাজার হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে দুইটি ইউনিটে ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য লাখ লাখ টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। আমদানিকৃত কয়লা খালাসের জন্য মাতারবাড়ীতে আড়াইশ মিটার প্রস্থ এবং ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল তৈরি করা হয়।

এই চ্যানেল নির্মাণের কাজ যখন চলছে তখন জাইকার একটি প্রতিনিধিদল বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে জানান যে, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের জন্য খননকৃত চ্যানেলেই বন্দর কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে খুব সহজে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বন্দরের বিশেষজ্ঞরা সরেজমিনে পরিদর্শনে যান এবং তারা বেশ চমকিত হয়ে লক্ষ্য করেন যে, কয়লা খালাসের জন্য যে অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে তাকে একটু সম্প্রসারণ করা হলে অনায়াসে একটি বন্দর নির্মাণ করা সম্ভব।

যেখানে খুব সহজে ১৬ থেকে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং দেয়া যাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং আলাপ আলোচনার পর মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চ্যানেলই ভবিষ্যতের গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের স্বপ্ন দেখা শুরু করে।

এখানে স্মরণ করা যায় যে, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের কিছুটা স্নায়ুবিবাদ চলছিল। কখনো সোনাদিয়া, কখনো মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সমীক্ষা চালানো হলেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখছিল না।

ভূরাজনৈতিক বেশ কিছু প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দরকে নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। এতে করে মাতারবাড়ীতে আকস্মিক এবং একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে গভীর সমুদ্রবন্দরের সুযোগ তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশ অনেকটা চুপিসারে প্রকল্পটি নিয়ে অগ্রসর হয়। গভীর সমুদ্রবন্দরের নামই মুখে আনছিলেন না সরকারের কেউ। মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছিল।

সবাইকে জানানো হচ্ছিল যে, চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারিত একটি অংশ হিসেবে মাতারবাড়ীতে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে বন্দর উন্নয়ন করা হচ্ছে।

কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জাহাজ বার্থিং এবং কয়লা খালাসের জন্য আড়াইশ মিটার প্রস্থ, ১৬ থেকে ১৮ মিটার ড্রাফটের ১৪.৩ কিলোমিটার চ্যানেল খনন করা হয়। নির্মাণ করা হয় জেটি।

এই চ্যানেল ধরে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট নিয়ে ইতোমধ্যে ১১২টি মাদারভ্যাসেল বার্থিং নিয়ে পণ্য খালাস করে নিরাপদে চলে গেছে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনে গড়ে তোলা চ্যানেলটি পুরোপুরি কার্যকর হয়ে উঠেছে। কিন্তু গভীর সমুদ্রবন্দর করতে হলে এই চ্যানেলের পুরোটাতেই ১৮ মিটার ড্রাফট নিশ্চিত করতে হবে।

পাশে বাড়াতে হবে ১০০ মিটার। অর্থাৎ পুরো চ্যানেলটি ১৮ মিটার ড্রাফটের সাড়ে তিনশ মিটার চওড়া করে নির্মাণ করতে হবে। ইতোমধ্যে চ্যানেলটিকে প্রত্যাশিত রূপে গড়ে তোলার কার্যক্রম পুরোদমে চলছে।

চমৎকার ড্রাফটের সুদৃশ্য চ্যানেলটি বড় বড় জাহাজকে বুকে নেয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে শুরু করলেও সংকট দেখা দিয়েছে এর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে। চ্যানেলটি নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হচ্ছে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

এরমধ্যে জাইকা প্রদান করেছে ৭ হাজার ১২২ কোটি ১৬ লাখ টাকা, বাকিটা সরকার। এখন বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চ্যানেল খননের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই শোধ করতে হবে। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে চ্যানেলের মালিক হবে বন্দর। এখানে জাহাজ চলাচলের রেভিনিউ পাবে বন্দর। তাই চ্যানেলের পুরো খরচ তাদের দিতে হবে।

কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, চ্যানেলটির বড় অংশ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। বন্দরের জন্য আংশিক বড় করতে হয়েছে। তাছাড়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এটিকে ১৪.৩ কিলোমিটার ভিতরে আনতে হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য এত দীর্ঘ চ্যানেল দরকার ছিল না। বন্দর এটিকে দুয়েক কিলোমিটার ভিতরে নির্মাণ করেই গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করতে পারতো।

ফলে বিশাল এই চ্যানেলের ব্যয় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য। খরচও তাদের দিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দর কষাকষি চলছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ চ্যানেল নির্মাণের অর্ধেক খরচ দিতে সম্মত হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক শীর্ষ নেতা বলেছেন, সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে চ্যানেল তৈরি করার কোনো ইচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষের ছিল না। এত বিশাল বিদেশি ঋণের বোঝা কাঁধে নেয়ার সক্ষমতাও বন্দরের নেই। বছর বছর এই ঋণের যে সুদ বহন করতে হবে তা পরিশোধ করা বন্দরের পক্ষে সম্ভব হবে না। সুদের পাশাপাশি প্রতিবছর মূল টাকাও পরিশোধ করতে হবে।

শুধু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আওতায় চ্যানেল খননের ঋণই নয়, বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নেও আলাদাভাবে জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। এতে করে চ্যানেল খননের বিশাল অংকের পাশাপাশি বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঋণের বেশ বড় অংকের দায় বন্দর কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে পড়ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে জাইকার ঋণ ২০২৬ সাল থেকে এবং বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নের ঋণ ২০২৯ সাল থেকে পরিশোধ করতে হবে

। দুই খাতের বিশাল ঋণের বোঝা যদি বন্দর কর্তৃপক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তাতে বন্দরে ৫/৭ কোটি টাকা আয় করা চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে এগুলো পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। জাইকাকে ঋণের মূল অংশ এবং সুদ মিলে প্রতিবছরই কয়েক শত কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। প্রাথমিক হিসেবে প্রথম বছরই পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১ হাজার ৮শ কোটি টাকা। পরবর্তীতে প্রতিবছর অন্তত ৫শ কোটির দায় থাকবে বন্দরের ঘাড়ে।

বিষয়টি নিয়ে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যে কমিটি চ্যানেল নির্মাণ, হস্তান্তর এবং অর্থ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদেরকে চ্যানেল নির্মাণের খরচ পুরোটার দায় নিতে বলা হচ্ছে। আমরা আমাদের অবস্থা এবং অবস্থান জানিয়েছি। দুটোই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এখন সরকার নিশ্চয়ই দুই প্রতিষ্ঠানের জন্য কল্যাণকর কোনো সিদ্ধান্ত নেবে। বিষয়টি নিয়ে কোনো বিরোধ নয়, আলাপ আলোচনা চলছে বলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকখনো দিনে কখনো রাতে সমানে চলছে পাহাড় নিধন
পরবর্তী নিবন্ধঅপহৃত রিকশাচালক হাটহাজারীতে উদ্ধার