তারিখটা ৩ মে ১৯৭১। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচাইতে বড় এবং নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডটি এদিন সংঘটিত হয় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত মোজাফ্ফরাবাদ গ্রামে। ওইদিন ভোরে মানুষ ঘুম থেকে ওঠার আগেই দোহাজারী থেকে আসা একদল পাকিস্তানি সেনা এবং পার্শ্ববর্তী খরণা ও এলাহাবাদের কতিপয় রাজাকার গ্রামটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। সকাল ৭-৮টার দিকে শুরু হয় বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যাযজ্ঞ। পাঁচ-সাত বছরের শিশু থেকে ৭০-৮০ বছরের নারী-পুরুষ মিলে প্রায় ৩০০ মানুষ হত্যা করা হয় বলে দাবি করেছেন স্থানীয় লোকজন। সরকারি বিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘পটিয়া মোজাফফরাবাদ বধ্যভূমিতে ৩রা মে ১৯৭১ সনে ভোর ৫.২০ মিনিটে পাকবাহিনী মোজাফফরাবাদ গ্রামে ঢুকে ৩০০ জনের অধিক নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়’। তবে ২০১০ সালে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সংগৃহীত তালিকায় ২৫৫ জন শহীদের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন- রায়মোহন বিশ্বাস, রাজবিহারী বিশ্বাস, শংকর সেন, রুহিনী দত্ত, রায়মোহন চৌধুরী, সত্যরঞ্জন কর, যোগেন্দ্র লাল চৌধুরী, ক্ষেমেশ চন্দ্র চৌধুরী, উপেন্দ্র লাল সেন, নির্মল সেন, নবীন বৈদ্য, ক্ষেত্রমোহন ঘোষ, হরিরাম চৌধুরী, সুরেন্দ্র সেন, দীপক সেন, উত্তম সেন, সুরবালা সেন, রজনী সেন, মানিক চৌধুরী, নিরঞ্জন চৌধুরী, বারেন্দ্র রায় চৌধুরী, সারদা সেন, বীরেন্দ্র দত্ত, নিরঞ্জন বিশ্বাস, সুমতি বল, সারদা সেন, বিমলা চৌধুরী, সরুবালা সেন, দুলাল সেন, রঞ্জিত সেন (ছেলেসহ), সরুবালা সেন, নতুন ঘোষ, আজলা ঘোষ, সোনা দাশ, বঙ্কিম সেন, কালী তারা কর, অন্নচরণ বৈদ্য, অবলা বালা মজুমদার, শৈলবালা চৌধুরী, কুসুম বালা সেন, মনিন্দ্র লাল বৈদ্য, মহেন্দ্র মজুমদার, মন মোহন মজুমদার, বীরেন্দ্র মজুমদার, দশরথ সেন, নগেন্দ্র চৌধুরী, নিরঞ্জন বৈদ্য, মনমোহন চৌধুরী, ভগবান চন্দ্র কর, হারাধন দাশ, যশোদা বালা কর, নিয়তিবালা সেন, চাঁদবালা মজুমদার, অক্ষয় কুমার ঘোষ, যোগেশ চৌধুরী, মল্লিকা মজুমদার, শ্যামাচরণ দাশ, কালিতারা দাশ, নগেন্দ্র সেন, বীরেন্দ্র সেন, অশ্বিনী কুমার দাশ, নিকুঞ্জ কুমার দাশ, রজনী চৌধুরী, সোনা মজুমদার, স্বর্ণবালা চৌধুরী, অরণ্যবালা চৌধুরী, বনমালি দাশ, যামিনি রঞ্জন দে, অর্জুন দে, রুনী দত্ত, মিলন সেন, যাত্রামোহন চৌধুরী, সাবিত্রী বালা বিশ্বাস, বিরজা বালা সেন, রঞ্জিত সেন, সুরসী বালা সেন, নিবারণ চন্দ্র ধর, নিকুঞ্জ বিহারী ধর, ডা. উমেশচন্দ্র সেন, সারদাচন্দ্র সেন, নিরোদা বালা সেন, সুখেন্দু বিকাশ সেন, রমেশচন্দ্র সেন, রসিক চন্দ্র সেন, মহামায়া সেন, প্রফুল্ল রঞ্জন রায়, নারায়ণ চন্দ্র রায়, মালতী রানী রায়, রবীন্দ্রলাল ঘোষ, নিরঞ্জন ঘোষ, শৈলবালা ঘোষ, বিনোদিনী সেন, গীতারানী সেন, নির্মল চৌধুরী, হরি কৃষ্ণ সেন, কামিনী চৌধুরী, মহেন্দ্র নাথ, সূর্য চৌধুরী, মহেন্দ্র দাশ, দেবেন্দ্র দাশ, মহেন্দ্র চৌধুরী, বীরেন্দ্র চৌধুরী, কামিনি নাথ, বিপিন সেন, সুরেন্দ্র চৌধুরী রায়, হরিমোহন সেন, রায়মোহন দাশ, শান্তিবালা ঘোষ, মালতী রানী রায়, রবীন্দ্র লাল ঘোষ, নিরঞ্জন ঘোষ, সুবলচন্দ্র ধর, সুরেন্দ্র বিজয় ঘোষ, ঘোষ, রেবতী ঘোষ, সুজিত নাথ, উত্তম নাথ, কুসুমবালা রায়, সুরশী বালা ঘোষ, অঞ্জলী ঘোষ, হিরাবালা রায়, হরিশচন্দ্র পাল, উপেন্দ্রলাল পাল, মনমোহন সেন, সুরেন্দ্রলাল ঘোষ, বামাচরণ ঘোষ, কুসুমবালা দাশ, ক্ষেত্রমোহন রায়, অশ্বিনী ঘোষ, নতুনচন্দ্র নন্দী, গগণচন্দ্র নন্দী, ক্ষেত্রমোহন নন্দী, মনিন্দ্রলাল ঘোষ রায়, কামিনি সিংহ, যোগেন্দ্র ঘোষ রায়, নিকুঞ্জ দে, তরণী ঘোষ, অধীর নন্দী, সোনা নন্দী, সুরেন্দ্র বিজয় চৌধুরী, শিব প্রসাদ সেন, মনিন্দ্রলাল নন্দী, ভূবন চৌধুরী, মনমোহন গুপ্ত, ললিত বিশ্বাস, শংকর কুমার সেন, অহিভূষণ সেন, প্রতাপচন্দ্র সেন, ধীরেন্দ্রলাল দত্ত, অর্জুন দত্ত, বনমালি চৌধুরী, হরিমোহন দাশ, নতুন চৌধুরী, রায়মোহন চৌধুরী, অনিল চক্রবর্তী, নিকুঞ্জ দাশ, অশ্বিনী দাশ, নির্মল সেন, উমেশ সেন, ক্ষেত্র মজুমদার, ক্ষেমশ চৌধুরী, শোভারাণী চৌধুরী, অনীল চৌধুরী (শোভারানীর বাবা), কালি কুমার মজুমদার, সুরেন্দ্র মজুমদার, কামিনি ঘোষ, রজনী ঘোষ, বামা সুন্দরী রায়, ঝুনু দে, হারিনা রানী চৌধুরী, গীতা সাধু, যাত্রামোহন ঘোষ, দুলাল চন্দ্র ঘোষ, নিখিল চন্দ্র দত্ত, নমিতা রানি দত্ত, নিরোদা বালা রায়, মালতী রানী দত্ত, সারদা চরণ দে, গীতা রাণী দত্ত, অরবিন্দ ঘোষ, নিবারণ ঘোষ, মালতী রানী ঘোষ, চন্দ্রমোহন ঘোষ, দুলাল মজুমদার, রুনী সেন, শারদা সেন, মানিক সেন, প্রাণহরি সেন, সুকুমার রায়, বনমালী রায়, নতুন ঘোষ, শারদা ঘোষ, সোনা রায়, হরিমোহন দত্ত, নতুন চন্দ্র পাল, যাত্রামোহন দত্ত, অশ্বিনী সেন, অনিলচন্দ্র দাশ, কালী কুমার দাশ, শোভারানী পাল, রামচরণ ঘোষ, নিরঞ্জন চৌধুরী, নতুন চন্দ্র ঘোষ, নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস, রজনী পাল, কামিনী পাল, গীতা রায়, শোভারায়, সন্তা চৌধুরী, অন্নদা চৌধুরী, ষষ্ঠীচরণ দাশ, অরণ্য চৌধুরী, রজনী চৌধুরী, অশ্বিনী কুমার দত্ত, অর্জুন দে, সতীশ কর, যুধীষ্ঠির ঘোষ, সুরেন্দ্র পান্থ, সুরেন্দ্র বিজয় পাল, সুধাংশু দত্ত, রামমোহন সেন, কৃষ্ণা চৌধুরী, স্বরস্বতী সেন, সতীশ সেন, হরিমোহন ঘোষ, অর্জুন চৌধুরী, শুভ্রত চৌধুরী, নতুন চৌধুরী, কুতুবালা চৌধুরী, মনিবালা ঘোষ, নিরোদা বালা কর, মনমোহন বৈদ্য, হরিরাম মজুমদার, মল্লিকা দে, কুসুমবালা কর, হরিমোহন কর, উপেন্দ্র লাল কর, মনমোহন দাশ, মনিন্দ্রলাল দত্ত, নিয়তিলাল কর, যশোদাবালা দত্ত, হিরেন্দ্রলাল সেন, মোহিনী সেন, শৈলবালা কর, সূর্যমোহন দত্ত, হরিকৃষ্ণ দত্ত, প্রাণহরি দত্ত, দশরথ সেন, রজনী কুমার দত্ত, রজনী কুমার দত্ত, নতুন চন্দ্র রায়।
নির্মমতার খণ্ডচিত্র:
সেদিনের হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতার কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন মিলন কান্তি চৌধুরী (শাহ আমীর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক)। তিনি জানান, ‘দেশের শান্তি ও মঙ্গল কামনায় সেদিন রামায়ণ পাঠে নিয়োজিত ছিলেন ৭০ বছরের বয়স্ক রজনী সেন। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলেন অস্ত্র হাতে হানাদার পাঞ্জাবি-সেই সঙ্গে বাঙালি দালালরাও। অতিথি হিসেবেই পিঁড়ি এগিয়ে দিয়ে বসতে বলেন সেন বাবু। বাঙালিদেরই একজন তাকে ‘জয় বাংলা’ বলতে বলে হেসে হেসে। চক্রান্ত বুঝতে না পেরে সরলপ্রাণ সেন বাবু ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে রাইফেলের নল ঢুকিয়ে গুলি ছোড়ে বর্বর এক পাঞ্জাবি সৈন্য। রামায়ণের ওপর পড়ে থাকে রজনী সেনের নিথর দেহ। একইভাবে গীতা পাঠরত অবস্থায় হত্যা করা হয় নবীন সাধুকে।’
মুজাফফরাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বাণীকাঞ্চন চৌধুরী জানান, ‘স্কুল শিক্ষক রায়মোহন ঘটনার সময় পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন। ভেবেছিলেন হয়তো নিরীহ মানুষ ভেবে মাছ ধরা অবস্থায় তাঁকে কিছু করা হবে না। কিন্তু এক মিলিটারি তাঁর জালটি কেড়ে নিয়ে সঙ্গে থাকা ছেলেসহ তাঁকে জাল দিয়ে পেঁচিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর দুজনকেই নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এলাকার গায়ক রোহিনী দত্ত এক নারীর কাপড় পরে কৌশলে পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ধরা পড়েন পাঞ্জাবির হাতে। সাহস করে সেই পাঞ্জাবিকে ধরে ফেলেছিলেন রোহিণী দত্ত। জোর করে টেনে নিয়ে পাশের জলহীন ডোবার কাদামাটিতে চুবিয়ে পাঞ্জাবিটিকে মারতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু টের পেয়ে তৎক্ষণাৎ অন্য এক পাঞ্জাবি সেনা গুলি করে রোহিণীকে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।’
‘গ্রামের কয়েকজন পূজারীকে ধরে নিয়ে জোর করে তাঁদের দিয়ে মন্দিরের বিগ্রহ ভেঙে ফেলা হয়। এরপর গুলি করে মারা হয় সেই পূজারীদের। সেই দিনটির কথা মনে পড়লে আজও সারা শরীর শিউরে ওঠে’-বলছিলেন, মুজাফফরাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ের পিয়ন রনজিৎ চৌধুরী। বাণীকাঞ্চন চৌধুরী ও রণজিৎ চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবিদের আগমনে আশপাশের রাজাকারদের ইন্ধন ছিল। খরণা গ্রামেই ছিল ১০০ জনের মতো রাজাকার। পাঞ্জাবিরা হত্যাযজ্ঞ ও অধিকাংশ বাড়িঘরে আগুন দিয়ে চলে যাবার পর অবশিষ্ট বাড়িঘরে রাজাকার ও বিভিন্ন এলাকার অসৎ লোভি লোকজন এসে লুটপাট চালায়। তবে ওই সময় পার্শ্ববর্তী জোয়ারা ও শোভনদন্ডী এলাকার অনেকের আচরণ ছিল সহানুভূতিশীল। মুজাফফরাবাদ থেকে পালানো অনেক নারী পুরুষকে শোভনদন্ডীর প্রকৌশলী ফজল আহমদের বাড়ি ও বর্তমান সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর বাড়িসহ আশেপাশের লোকজন যতটুকু পারেন খাবার দাবার ও আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। বাণী কাঞ্চন চৌধুরী নিজেও পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন ফজল আহমদ ইঞ্জিনিয়ারের সহযোগিতায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী মোজাফ্ফরাবাদ গ্রাম এবং সেখানকার উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শন করেন। সে সময় উপস্থিত লোকজন তাঁকে জানান, হানাদার ও তাদের দোসরেরা ৩০০ মানুষকে হত্যা করেছে এবং সকল বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। (দৈনিক আজাদী ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২)
স্বাধীনতার পর শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার গড়া হয়েছিল। ‘শহীদের রক্ত ভুলব না’ শীর্ষক নাটক লিখেছিলেন সুনীল সেন। তাঁর পরিচালনায় নাটকটি পরিবেশিত হয় ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর। দিনটি স্মরণে প্রতিবছর নিহতদের স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো ও আলোচনা সভার আয়োজন করে এলাকাবাসী। শহীদ মিনারের আদলে গড়া পুরোনো জীর্ণ স্মৃতিসৌধটির সামনে নতুন একটি সৌধ হয়েছে।
লেখক : সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।