পানির অপর নাম জীবন। বিশ্বজগতে জীবন ও প্রাণের বাহক হচ্ছে এই পানি। তাই জীবনের সাথে পানির আন্তঃসম্পর্ক সুনিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। পানি আবার জীবিকারও অংশ। জীব ও জগতের জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে নিরাপদ পানি। নিরাপদ পানি বলতে যে পানিতে ময়লা, আবর্জনা ও রোগ-জীবাণু থাকে না তাকেই বোঝায়। আর নিরাপদ পানি মানে বিশুদ্ধ পানি। পৃথিবীর উপরিভাগের চারভাগের তিনভাগই পানি। সব পানিই আবার নিরাপদ বা বিশুদ্ধ নয়। বিভিন্ন উৎস হতে আমরা পানি পাই। বৃষ্টি, নদী, নালা, খাল, বিল, হ্রদ, সমুদ্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎস থেকে আবার মনুষ্য সৃষ্ট উৎস পুকুর, কুয়া, নলকূপ, পানির কল ইত্যাদি থেকে পানি পাই। মানুষের শরীরে শতকরা ৬০ ভাগ থেকে ৭০ ভাগ পানি থাকে। মানবদেহে উৎপন্ন বর্জ্য নিষ্কাশনে ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পানি অত্যন্ত দরকার। তাই দিনে অন্তত দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করা উচিত। বিশুদ্ধ বা নিরাপদ পানি সব ধরনের মানবাধিকারের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। পানির গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভা ২২ মার্চ দিনটিকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিইডি) এজেন্ডা-২১ এ বিশ্ব পানি দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ থেকে এই দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহ গুরুত্বসহকারে পালন করে আসছে। পৃথিবীর ২ বিলিয়ন মানুষ এখনো নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। বিশ্বব্যাংক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের জরিপ মতে বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশের বেশি মানুষের উন্নত উৎসের পানি পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে পুরোপুরি নিরাপদ পানি পানের সুযোগ এখনও সীমিত যার পরিমাণ ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
ইউনিসেফের তথ্যমতে আর্সেনিকযুক্ত পানি পানকারীর হার ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তারপরও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিকদূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। উন্নতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে ১ কোটি ৯৪ লাখ মানুষ এখনো সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। এক তৃতীয়াংশ পানির উৎসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় ম্যাঙ্গানিজের বিদ্যমানতা পাওয়া যায়। শহরাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ পানিতেই উচ্চমাত্রার ই-কোলাই ব্যাক্টেরিয়া থাকে, যা ডায়রিয়ার কারণ। প্রতি পাঁচটি পরিবারের দুটি অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া দূষিত উৎসের পানি পান করে। তাছাড়া ঘন ঘন বন্যা, ভূমিধ্বস ও ঘর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও পানির উৎস দূষিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অধিক সংখ্যক মানুষের নগরাভিমুখিতা পরিবেশগত দুর্যোগের কারণ। শিল্পবর্জ্য, সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলন, ফসল চাষে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং জমিতে লবণাক্ত পানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণও বাংলাদেশের পানির গুণগতমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০১৮ সালে অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের জরিপে দেখা যায়, বাসা-বাড়িতে যে পানি সরবরাহ হয় সেখানে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ প্রায় ৮২ শতাংশ। বিবিসি’র মতে পানিকে সাতটি উপায়ে শতভাগ বিশুদ্ধ করা সম্ভব। ১. ফুটিয়ে- পানি বিশুদ্ধ করার সবচেয়ে পুরানো ও কার্যকর পদ্ধতি হলো ফুটিয়ে পান করা।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী পানি ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় ৫ থেকে ২৫ মিনিট ধরে ফোটানো হলে এর মধ্যে থাকা জীবাণূ, লার্ভাসহ সবই ধ্বংস হয়ে যায়। ২. ফিল্টার-পানি ফোটানোর মাধ্যমে ক্ষতিকর জীবাণু দুর করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত থাকতে ফিল্টারের সাহায্যে বিশুদ্ধ করা যেতে পারে। ৩. ক্লোরিন ট্যাবলেট বা ব্লিচিং- পানির জীবাণু ধ্বংস করতে বহুল ব্যবহৃত একটি রাসায়নিক হলো ক্লোরিন। পানি যদি ফোটানো বা ফিল্টার করার ব্যবস্থা না থাকে তাহলে পানি বিশুদ্ধিকরণে ক্লোরিন ট্যাবলেট দিয়ে পরিশোধন করা যেতে পারে। ৪. পটাশ বা ফিটকিরি- সামান্য পরিমাণ ফিটকিরি মিশিয়ে দুই থেকে তিন ঘন্টা রেখে দিলে পানির ভেতরে থাকা ময়লাগুলো তলানিতে স্তর হয়ে জমে। এ ক্ষেত্রে পাত্রের উপর থেকে শোধিত পানি সংগ্রহ করে তলানির পানি ফেলে দিতে হবে। ৫. সৌর পদ্ধতি- এ পদ্ধতিতে দূষিত পানিকে জীবাণুমুক্ত করতে কয়েকঘন্টা তীব্র সূর্যের আলো ও তাপে রেখে দিতে হবে। এতে করে পানির সব ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয়ে যায়। ৬. আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি- পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানি জীবাণুমুক্ত করার জন্য অতিবেগুনি বিকিরণ কার্যকরী একটা পদ্ধতি। এতে পানির ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়। ঘোলা পানিতে বা রাসায়নিকযুক্ত পানিতে এই পদ্ধতিটি ততটা কার্যকর নয়। এই পদ্ধতি আবার ব্যয়বহুল। ৭. আয়োডিন- এক লিটার পানিতে দুই শতাংশ আয়োডিনের দ্রবণ মিশিয়ে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখলেই পানি বিশুদ্ধ হয়ে যায়। তবে কাজটি কোন দক্ষ ব্যক্তি দ্বারা করা অত্যাবশ্যক। কারণ পানি ও আয়োডিনের অনুপাত ঠিক না থাকলে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২০৩০ সাল নাগাদ দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য সুপেয় পানি প্রাপ্তির টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে পানির চারটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো হলো প্রাপ্যতা, প্রবেশগম্যতা, গুণগত মান ও পানি পাওয়ার আর্থিক সক্ষমতা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের সতেরটি লক্ষ্যের মধ্যে ছয় নম্বরটি সুপেয় পানি নিয়ে যা ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য খরচ করতে হবে ১৩৫ বিলিয়ন টাকা। নিরাপদ পানির জন্য সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। রোটারি ফাউন্ডেশনও নিরাপদ পানি, সেনিটেশন ও স্বাস্থ্যখাতে বিশ্বব্যাপী ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করছে। করোনা মহামারির বৈশ্বিক বিপর্যয়ে হাত ধোয়ার উপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। হাত ধোয়ার জন্যও প্রয়োজন নিরাপদ পানি যা আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য। নিরাপদ পানি মানে নিরাপদ জীবন।
লেখক : প্রাবন্ধিক