নিম্নআয়ের মানুষের চাপা কান্না

কেউ পেতেছেন হাত, কেউ ধারে চালাচ্ছেন সংসার

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২১ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

কাজলী দাশ থাকেন নগরীর দেওয়ানবাজার ভরাপুকুর পাড় এলাকার ভাড়া বাসায়। এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে টানাপোড়েনের সংসার। তিনি অন্যের বাসায় কাজ করতেন। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রায় এক বছর ধরে কর্মহীন। ছেলে সুমন দাশ (২৩) সিরাজদৌল্লা রোডের মাছুয়া ঝরনা এলাকায় মুচির কাজ করে সংসারের খরচ মেটাতেন। কিন্তু চলতি লকডাউনে রাস্তার পাশে জুতো সেলাই কিংবা পালিশের কাজও বন্ধ। অন্য কোনো কাজও নেই, যা করে খাবার জোগাড় করবেন। খাবার নেই, বকেয়া পড়েছে বাসা ভাড়াও। অগত্যা সাহায্যের জন্য পথে নেমেছেন কাজলী দাশ ও সুমন। সোমবার বিকেলে নগরীর মিসকিন শাহ মাজারের সামনের ফুটপাতে প্রায় অর্ধশত অসহায় নারী-পুরুষের পাশে কাজলীও বসে পড়েছেন। খাবারের পুটলি কিংবা অন্য কিছু নিয়ে কেউ এসে দাঁড়ালেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন অসহায় মানুষগুলো। সবার অসহায় চাহনি। কর্মহীন অবস্থায় খাবারের যন্ত্রণা তাড়া করছে। এনজিওর ঋণ পরিশোধ করতেও ছোটাছুটি অনেকের। কাজলী দাশেরও রয়েছে ঋণের বোঝা। কাজলী দাশ বলেন, মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চলত। যে বাসায় কাজ করতাম করোনা শুরুর পর তারা কাজে যেতে মানা করে দিয়েছেন। প্রায় এক বছর হচ্ছে হাতে কাজ নেই। আমার ছেলে সুমন জুতো সেলাইয়ের কাজ করত। লকডাউন শুরুর পর থেকে সেও বেকার। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছি। হাত পাততে হচ্ছে।
সুমন বলেন, গত বছরের লকডাউনে অনেকে সহায়তা করেছেন। চাল-ডাল-আলু দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা হতো। এবার তাও নেই। আমরা একেবারে অসহায়। কাজলী দাশ ও সুমনের মতো নগরীতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন নিম্নআয়ের অনেক মানুষ। কঠোর লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ, বন্ধ অফিস-আদালতও। দিনমজুর থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী অনেকেরই কাজ নেই। নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে চোখে পড়েছে মানুষের অসহায়ত্ব। দোকানপাট খুললে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরিশোধ করবেন এমন আশ্বাসে লকডাউনে অনেকে ধার করে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকে নেমে গেছেন ভিক্ষা করতে।
বিকেল সাড়ে তিনটা। আসকার দিঘির পাড়ে বন্ধ ফার্নিচার দোকানের সামনে তালা লাগানো ভ্যানগাড়ির উপর বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন মোজাম্মেল। গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। ভ্যানগাড়ি চালিয়ে সংসার চালান। লকডাউনে কাজ নেই। দুটি ছোট সন্তান, চারজনের সংসার।
মোজাম্মেল বলেন, গ্রামে একটি ময়দার মিলে কাজ করতাম। ৪ বছর ধরে চট্টগ্রামে আছি। ভ্যান চালিয়ে ৫-৭শ টাকা আয় হয়। তবে সবসময় একইভাবে কাজ থাকে না। ব্যাটারি গলি এলাকার ৫ হাজার টাকা ভাড়ায় ছোট্ট একটা বাসায় থাকি। গত দুই সপ্তাহে তেমন কাজ হয়নি। খরচের টাকাও নেই। তাই বাধ্য হয়ে ফোন করে শ্বশুর থেকে টাকা চেয়েছি। রবিবার তিনি দুই হাজার টাকা পাটিয়েছেন। এই টাকা খরচ হলে আবার কর্জ করতে হবে।
ঠাকুরগাঁও জেলার মুজিবর (৪৫) ২০ বছর ধরে চট্টগ্রামে থাকেন। ভ্যানগাড়ি চালিয়েই সংসার চালান। চার সন্তানসহ পরিবার নিয়ে বর্তমানে সাড়ে ৬ হাজার টাকা ভাড়া বাসায় থাকেন। গত মাসে জমিদার ভাড়া এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ায় নতুন বাসা নিয়েছেন ব্যাটারি গলি এলাকায়। আগের বাসায় ২০ হাজার টাকা ভাড়া বকেয়া। নতুন বাসার জন্য ১০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। লকডাউন শুরু হওয়ায় কাজ বন্ধ আছে। এখন পড়েছেন উভয় সংকটে।
তিনি বলেন, লকডাউন আমাকে পথে বসিয়েছে। এখন না পারছি ভিক্ষা করতে, না পারছি চুরি করতে। রমজান মাস, গত কয়েকদিন ধার দেনা করে খাবার কিনেছি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। নামতে হবে রাস্তায়।
ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চকবাজার এলাকায় ঠেলাগাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন অনেক শ্রমিক। তাদের একজন মো. বাবুল। মা-বাবা, তিন ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী মিলে ৭ জনের সংসার। বাবুলই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। রয়েছে এনজিওর ঋণ। প্রতি সপ্তাহে কয়েক হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। এখানে বাবুলের মতো সবারই কম-বেশি এনজিওর ঋণ রয়েছে। কাজ বন্ধ থাকলেও কিস্তি বন্ধ নেই। টাকা না থাকলে ঘরের ব্যবহার্য জিনিস বিক্রি করেও অনেক সময় কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।
বাবুল বলেন, প্রতিদিন ৫-৭শ টাকা আয় করি। অনেক সময় বেশি-কম হয়। দুই সপ্তাহ ধরে তেমন কাজ নেই। কাল ৭ হাজার টাকার কিস্তি রয়েছে। কোত্থেকে দেব ভেবে পাচ্ছি না। বাসায় যে চাল আছে তাতে কালকেও যাবে না। এখন লকডাউন থাকলে নতুন করে কর্জ করতে হবে। কর্জ না পেলে না খেয়ে মরতে হবে।
শুধু বাবুল নন, জয়নাল, আবছারসহ আরও প্রায় ৩০ জন ঠেলাগাড়ি শ্রমিকের অবস্থা একই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগলিতে পুলিশ ঢুকলেই বন্ধ হয়ে যায় দোকান
পরবর্তী নিবন্ধমিটার ভাড়া আদায়ে কঠোর কেজিডিসিএল