নিখুঁত এক স্থপতির গল্প

কক্সবাজার প্রতিনিধি | রবিবার , ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের বালুকাময় সৈকতে প্রায় ৪/৫ প্রজাতির কাঁকড়া দেখা গেলেও কেবল সাগরদোনাতেই লাল কাঁকড়ার ব্যাপক বিচরণ দেখা যায়। ভূ-তাত্ত্বিক কারণে সমুদ্র ও মূল ভূখণ্ডের মাঝখানে যে নিচু ভূমি তৈরি হয়, তাকে ইটল্যান্ড অথবা চ্যানেল বলা হলেও স্থানীয় ভাষায় এটা ‘সাগরদোনা’ নামে পরিচিত। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সৈকতের যেখানে এই ধরনের সাগরদোনা তৈরি হয়েছে, সেখানে দেখা মেলে লাল কাঁকড়ার। সম্প্রতি একদল গবেষকের সঙ্গে কক্সবাজার-টেকনাফ সৈকত পরিদর্শনে গিয়ে এই তথ্য জানা যায়।
সমুদ্র তীরবর্তী পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট ছোট ছড়া বা খালগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে যখন পানি প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে আসে, তখন সেই পানি সরাসরি সাগরে না গিয়ে সৈকতের লেগুনা অথবা সাগরদোনায় জমা হয়। এসব সাগরদোনা অথবা লেগুনার আশেপাশেই বেশি প্রজনন করতে দেখা যায় লাল কাঁকড়াকে। তবে সামুদ্রিক স্রোতের কারণে নানা সময়ে সৈকতের নানা স্থানে এই ধরনের লেগুনা তৈরি হতে পারে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
সম্প্রতি উখিয়ার সোনারপাড়া সৈকতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে তৈরি হওয়া সাগরদোনায় হাজার হাজার লাল কাঁকড়া বিচরণ করছে। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দূরের এই সৈকতে জেলে ও স্থানীয়রা ছাড়া তেমন পর্যটকের দেখা মেলে না।
স্থানীয় জেলেরা জানান, সোনারপাড়া সৈকতে এ বছর সবচেয়ে বেশি লাল কাঁকড়ার দেখা মিলছে। এখানে তৈরি হওয়া সাগরদোনাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার লাল কাঁকড়া বাসা বেঁধেছে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. শরীফ জানান, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সৈকতে প্রায় ৪/৫ প্রজাতির কাঁকড়া দেখা গেলেও মানুষের কাছে, বিশেষ করে পর্যটকদের কাছে লাল কাঁকড়া বেশি আকর্ষণীয়। ফলে যে সৈকতে লাল কাঁকড়া বেশি দেখা যায় সেই সৈকতে পর্যটকেরা বেশি
যায়। আর পর্যটকদের উৎপাতে লাল কাঁকড়া স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়।
তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও সোনারপাড়া সৈকতের মতোই লাল কাঁকড়ার ব্যাপক বিচরণ দেখা যেত হিমছড়ির আমতলীর ছড়া মোহনা ও দরিয়ানগরের বিভিন্ন পয়েন্টে। কিন্তু এখন সেখানে কদাচিৎ দেখা মেলে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, লাল কাঁকড়া নির্জনতা পছন্দ করে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে আমাদের পরিবেশ থেকে লাল কাঁকড়ার মতো বহু উপকারী প্রাণী ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অথচ এরা আমাদের জন্যই কাজ করে।
বিজ্ঞানীরা জানান, লাল কাঁকড়া কেবল কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনকারী একটি প্রাণী নয়, সৈকতের একটি অপরিহার্য প্রধান বায়োটার্বেটর। যে প্রাণী বা উদ্ভিদ মাটি বা কাদার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে মাটির গুণাগুণের পরিবর্তন ঘটায় তারাই বায়োটার্বেটর। লাল কাঁকড়া বায়োটার্বেশনের মাধ্যমে মাটির ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক গুণাগুণের পরিবর্তন ঘটিয়ে খাদ্য সার্কেলের বিভিন্ন জীব-অণুজীব ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করে। সৈকতের মাটির লবণাক্ততাও হ্রাস করে লাল কাঁকড়া।
তীব্র গরমের সময় সৈকতের বালুকাময় মাটির উপরের তাপমাত্রা যখন ৪৮ ডিগ্রিতে ওঠে, তখন কাঁকড়ার গর্তের তাপমাত্রা থাকে মাত্র ৩২ ডিগ্রি। ৯ থেকে ১৭ ইঞ্চি গর্ত করে এই কাঁকড়া মাটির নিচে অক্সিজেন সরবরাহ করে। গর্ত তৈরির মাধ্যমে সে ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চ তাপমাত্রা থেকে যেমন রেহাই পায়, মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর কবল থেকেও বাঁচে। এতে মাটির নিচের ক্ষুদ্র প্রাণীকূলের বসবাসের জন্যও আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, কক্সবাজার সৈকতের লাল কাঁকড়া একটি নিখুঁত ও অবিকল্প পরিবেশ প্রকৌশলী। একটি নিখুঁত স্থপতি, ভূ-রাসায়নিক প্রকৌশলী, জৈবিক প্রকৌশলী, ভৌত প্রকৌশলী ও জলবায়ু প্রকৌশলী। প্রকৃতিতে তার বিস্তৃত সেবা সম্পর্কে গবেষণায় দিন দিন নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা জানান, লাল কাঁকড়া ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য জালগুলোতে একটি মূল পরিবেশগত সংযোগ তৈরি করে। মাটিতে থাকা জৈব পদার্থের বণ্টন পরিবর্তন ঘটায়। পলিতে থাকা বিভিন্ন প্রাণীর খাবার উন্মুক্ত করে, খাবারের গুণগত পুষ্টিমান বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া মাটিতে লবণাক্ত কমায় ও পানিতে কার্বন সরবরাহের মাধ্যমে অগভীর সামুদ্রিক জলজ পরিবেশের পানির কলামে রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
লাল কাঁকড়া তার গিলের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে। অক্সিজেন গ্রহণের সুবিধার্থে সে সমুদ্র উপকূলের সোয়াশ ও সার্ফ জোনের (সর্বোচ্চ জোয়ার-ভাটার নিচের স্তর, যা ওঠানামা করে) পলিমাটি থেকে তার গিলগুলোতে আর্দ্রতা মিশ্রিত করে। এতে পলিকণায় পানির জৈবিক পরিবহন ধ্বংস হয়ে যায় এবং রাসায়নিক গুণাগুণ পরিবর্তন করে দেয়। সে পানিতে কার্বনও সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে সে পানির কলাম ঠিক রাখে।
লাল কাঁকড়ার ইংরেজি নাম জবফ মযড়ংঃ পৎধন, প্রাণিতাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক নাম ঙপুঢ়ড়ফব সধপৎড়পবৎধ। এই ক্রান্তীয় প্রাণীটিকে খাদ্যের প্রাপ্যতা ও মানুষের আচরণের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের প্রায় সকল উষ্ণ মণ্ডলীয় ও অর্ধ উষ্ণমণ্ডলীয় সৈকতে দেখা যায়।
লাল কাঁকড়া সর্বভূক প্রাণী। তবে সৈকতের মাটিতে থাকা কাদা বা পলল থেকে উদ্ভিদ বা প্রাণীর গলিত অংশ বের করে যখন সে খায়, তখন মাটিতে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে যায়। এতে মাটির বন্ধন তৈরি হয়, মাটি থেকে দূষিত পদার্থ দূরীভূত করে বায়ু দূষণ হ্রাস করে। এছাড়া মাটি থেকে কাদা হ্রাস পাওয়ায় বালুকণাগুলো শুষ্ক ও হালকা বস্তুতে পরিণত হয়ে বালিয়াড়ি তৈরিতে সহায়ক হয়। এভাবে লাল কাঁকড়া মাটিতে লবণের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ ঠিক রাখে। লাল কাঁকড়ার অভ্যাসগত কার্যক্রম সমুদ্রের নোনা পানির সাথে ভূ-গর্ভস্থ মিঠাপানির প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রতীরের বালিয়াড়িগুলোর মাত্র ১০ ফুট গভীরে টিউবওয়েল বসিয়েও স্বচ্ছ ও মিঠাপানি পাওয়া যায়। বর্ষাকালে বালিয়াড়িগুলোতে সামুদ্রিক লোনা পানির ধাক্কা লাগে। তবু এখানে ১০ ফুটের নিচে থাকে মিষ্টি পানির মজুদ। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি স্বচ্ছ পানির তুলনায় অনেক ভারী হলেও এক অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা ভূ-পৃষ্ঠের মিঠা পানির স্তরকে নিরাপদে রেখেছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, বসবাস ও বংশ বিস্তারের জন্য লাল কাঁকড়া সৈকতের মাটিতে যে গর্ত তৈরি করে, তা করা হয় এক নিখুঁত স্থাপত্য কৌশল ও আবহাওয়া কৌশলের সাহায্যে। শিল্পী বা স্থপতি হিসাবে তার গাণিতিক ও জ্যামিতিক দক্ষতা নিখুঁত। তারা ইংরেজি আই, জে, এল, ইউ এবং অর্ধ ইউ আকারের গর্ত তৈরি করে। সাধারণত গর্তের গভীরতা হয় ৯ থেকে ১৭ ইঞ্চি পর্যন্ত। গর্তের সর্বনিম্ন অবস্থান থাকে পানির লেভেলের প্রায় ১/৩ ইঞ্চি উপরে। এই প্রকৌশলের মাধ্যমে সে ভূ-পৃষ্ঠের উপরের তাপমাত্রার সাথে গর্তের নিচের তাপমাত্রায় নাটকীয় পার্থক্য তৈরি করে। এই কৌশলের মাধ্যমে সে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে রক্ষা করে। আবার মাটির নিচে অক্সিজেন সরবরাহ করে। মাটির নিচের তাপমাত্রা সহনীয় রেখে অন্যান্য জীব-অণুজীবের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
সামুদ্রিক মৎস্য বিজ্ঞানী ড. শফিক জানান, লাল কাঁকড়ার প্লাঙ্কটনিক লার্ভা মাইক্রো এলগিসহ অনেক অণুজীবের খাদ্য। তার ডিম থেকে খুব কমই বাচ্চা ফোটে এবং বড় হয়ে পরিবেশে ফিরে আসে। একটি লাল কাঁকড়া প্রায় ৩ বছর বাঁচে। মরে গেলে সে অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য হয়। তার শরীরের শক্ত অংশগুলো মাটিকণায় পরিণত হয়। সে নিজে নিখুঁত শিকারী, আবার কিছু প্রাণীর শিকারও। প্রকৃতির এ কৌশল থেকে সবাই লাভবান হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাউজানে হেফজখানায় শিশুর রহস্যজনক মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধকালুরঘাট সেতুতে এবার দেড় ঘণ্টার দুর্ভোগ